সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইমাম খোমেনীর জীবন : এক ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস

রুহুল্লাহর গল্প
ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল মুসাভী আল খোমেনী।

বিশ্ব ইমাম খোমেনীকে প্রথমবারের মত চিনেছে ১৯৭৮ সালের শেষাশেষি, যখন ইরানের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারণে তিনি ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। প্যারিসের অদূরে বসে ইরানের শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনীর ঘোষিত যুদ্ধ এবং আমেরিকা বিরোধী কঠোর বক্তব্য এক অভূতপূর্ব মিডিয়া কাভারেজ এনে দিলো, এবং ইমামকে বিংশ শতকের অন্যতম বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে পরিচিত করলো। পত্র-পত্রিকা আর নিউজ বুলেটিনে তাঁর ছবি ভরে উঠলো। এই ছবি বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কাছে, বিশেষতঃ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিতান্তই অপরিচিত ছিলো। সাদা দাড়ি এবং কালো পাগড়িধারী এই মানুষটিকে দেখে মনে হতো যেনো ইতিহাসের পাতা থেকে সময় অতিক্রম করে বর্তমানে চলে এসেছেন। তাঁর সমস্তকিছুই ছিলো নতুন আর অপরিচিত। এমনকি তাঁর নামটিও : রুহুল্লাহ। আর দুনিয়ার অসংখ্য পলিটিশিয়ান ও সাংবাদিকদের মনে যে প্রশ্নটি নাড়া দিয়ে যাচ্ছিলো, তা ছিলো : কী ধরণের বিপ্লবী মানুষ এই খোমেনী ?

আব্রাহাম লিঙ্কন, লেনিন, চার্চিল, হিটলার, মুসোলিনির মত বিপ্লবী থেকে শুরু করে আবদুল নাসের, নেহেরু, ক্যাস্ট্রো হয়ে এমনকি চে গিভারার কথায় মুখর দুনিয়ার মাঝে খোমেনী ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি এমন এক ইসলামী বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যার বিজয় ছিলো অবধারিত। তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন না, ছিলেন না ক্যাপিটালিস্ট কিংবা ন্যাশনালিস্ট। প্রথমত তিনি ছিলেন একজন ইসলামী নেতা, দ্বিতীয়ত ইরানের জনগণের নেতা। তাঁর শ্লোগান ছিলো : পশ্চিমের মতও নয়, পূর্বের মতও নয়, শুধু ইসলামী প্রজাতন্ত্র চাই।
ইরানের ম্যাপ।

ইমাম খোমেনীর পিতার নাম ছিলো সাইয়্যেদ মোস্তফা মুসাভি আল খোমেনী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উঁচুদরের আলেম। ইরাকের নাজাফ ও সামেরায় পড়াশুনা করে একজন বিশিষ্ট মুজতাহিদ হিসেবে পরিচিত হন তিনি। খোমেইন প্রদেশে অত্যন্ত প্রভাবশালী ইসলামী নেতা ছিলেন তিনি। কিন্তু তৎকালীন অত্যাচারী জমিদার শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কারণে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আর এসময়েই জন্ম হয় তাঁর তৃতীয় সন্তানের : সাইয়্যেদ রুহুল্লাহ আল মুসাভি আল খোমেনী। যিনি কালক্রমে হয়ে ওঠেন আয়াতুল্লাহ খোমেনী, এবং একপর্যায়ে ইরানসহ সারাবিশ্বের অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষের বিপ্লবের চেতনা : ইমাম খোমেনী।

ইমাম খোমেনীর জীবন ও ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিস্ময়কর ইতিহাস বিশ্বের বহু মুক্তিকামী মুসলমানের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।

জন্ম ও শৈশব
শৈশবে ইমাম খোমেনী।

ইরানের খোমেইন প্রদেশে এক সম্ভ্রান্ত আলেমের গৃহে জন্ম নেয়া রুহুল্লাহ খোমেনী জন্মের পর পিতার মুখ দেখার সুযোগ পাননি। অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জিহাদে তাঁর পিতা শহীদ হন। এতিম রুহুল্লাহ খোমেনী তাঁর জীবনের মাধ্যমে ইতিহাস গড়তে শুরু করেন। তার জীবন ছিলো বিস্ময়কর, যেনো ইসলামী এক বিপ্লবের জন্যই আল্লাহ তায়ালা তাকে প্রস্তুত করছিলেন। সাত বছর বয়সে কুরআনের হাফেজ, পরবর্তী কয়েক বছরে গণিত শিক্ষা সমাপ্ত, সহপাঠীদের পড়া বুঝতে সাহায্য করার মাধ্যমে শিক্ষকতার আরম্ভ, খেলাখুলা, সাঁতার, দৌড়, ঘোড়ায় চড়া, এমনকি অস্ত্র পরিচালনা পর্য়ন্ত – সবকিছুতেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং অত্যন্ত দক্ষ হয়ে বেড়ে ওঠেন ইমাম খোমেনী। সেসময়ে ইরানকে সম্মিলিতভাবে শাসন করতো ব্রিটেন ও সোভিয়েত রাশিয়া। রাশিয়ান বাহিনী আক্রমণ করলে আত্মরক্ষার জন্য ১২ বছর বয়সে বড় ভাইয়ের সাথে অস্ত্রও ধরেন তিনি।
তরুণ রুহুল্লাহ খোমেনী।

১৫ বছর বয়সে মা মারা যান। ইতোমধ্যেই তিনি আরবী সাহিত্য অধ্যয়নসহ বড়ভাই আয়াতুল্লাহ পসন্দিদাহ এর কাছে যুক্তিবিদ্যা, আরবী ব্যাকরণ, ইত্যাদি শিক্ষা করেন। এরপর ১৭ বছর বয়সে আরাকে গমন করে শেখ মুহাম্মদ গোলপায়গানীর কাছে উচ্চতর যুক্তিবিদ্যা ও আব্বাস আরাকীর কাছে শরহে লুময়া নামক ফিকাহর বই অধ্যয়ন করেন।

কোম নগরীতে গমন
১৮ বছর বয়সে কোমে অধ্যয়ন শুরু।

১৮ বছর বয়সে ইরানের ধর্মীয় নগরী কোম - এ গমন করেন ইমাম খোমেনী, যেখানে তাঁর বিপ্লবী জীবনের সূচনা হয়। সেখানে তিনি ফিকাহ শাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু অপরাপর আলেমদের মত তিনি কেবল ফিকাহ শিক্ষাতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি যুক্তি ও দর্শন শাস্ত্রের পাশাপাশি ইসলামের ইরফানী (আধ্যাত্মিক) শাখায় জ্ঞান অর্জন করতে শুরু করেন। তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিলো এই বিষয়ে। দর্শন ও ইরফানী ধারায় তিনি প্রায় সাত বছর শিক্ষা নেন কোমের আলেম শেখ মুহাম্মাদ আলী ইসফাহানী শাহ আবাদীর কাছে। এভাবে বিভিন্ন নামকরা আলেমের কাছে বিশেষায়িত শিক্ষায় দীক্ষা নেন তিনি।

তবে কোমের বেশিরভাগ আলেমই পলিটিক্স থেকে সচেতন দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। এর কারণও ছিলো বটে। অত্যাচারী শাসকের বিরোধিতা করলে সে সময়ে গোটা মাদ্রাসা-ই বন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কা ছিলো। সুতরাং পণ্ডিতগণ কৌশলগত কারণে শরিয়া শিক্ষা দেবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। তবে ইমাম খোমেনী মাঝে মাঝে তেহরানে যেতেন এবং আয়াতুল্লাহ হাসান আল মুদাররেস এর পলিটিকাল বিষয়ের লেকচার শুনতেন। আয়াতুল্লাহ হাসান আল মুদাররসে ছিলেন এ ব্যাপারে সমসাময়িক আলেমগণের ব্যতিক্রম।

রেজা পাহলভীর ক্ষমতা গ্রহণ
রেজা শাহ পাহলভী।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভের পর ইরানে নতুন সরকার নিয়োগ করলো ব্রিটেন। সমর এবং অর্থ মন্ত্রণালয় সরাসরি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবার আইনী বৈধতা লাভ করলো। আয়াতুল্লাহ মুদাররেস, যাঁর পলিটিকাল লেকচার শুনতে ইমাম খোমেনী মাঝে মাঝে তেহরান গমন করতেন, তিনি রাজা আহমদ শাহকে চাপ প্রয়োগ করলেন অপমানজনক আইন প্রত্যাহার করতে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, সেসময়ের শাসকেরা আলেমগণকে সমীহ করতেন একারণে যে সাধারণ মানুষের মাঝে আলেমগণের অত্যন্ত সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা ছিলো। যাহোক, ব্রিটেনকে নির্লজ্জভাবে সমর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ দেবার কারণে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। শায়খ মুহাম্মাদ আল খায়বানি ও মির্জা কুজাক খান সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ব্রিটেন এক ইরানি সাংবাদিককে প্রাইম মিনিস্টার নিয়োগ করলো। আর এই নতুন প্রাইম মিনিস্টারের সাথে ষড়যন্ত্র করে আর্মি অফিসার রেজা শাহ ক্ষমতা দখল করে নিলো। ক্ষমতায় এসেই শুরু করলো বিরোধীমতের সকলকে গণগ্রেফতার।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হলো রেজা শাহ এর শাসন – রেজা শাহ, ইমাম খোমেনীর বিপ্লব যার ছেলের পতনের মাধ্যমে সাফল্য লাভ করে আরো প্রায় অর্ধশত বছর পরে। শুরু হলো ইরানে পাহলভী রাজবংশের শাসন। আর প্রায় একইসময়ে কোম নগরীর সুবিশাল ফায়জিয়া মাদ্রাসায় শুরু হলো ইমামের প্রাথমিক বিপ্লব, আর তা ছিলো তৎকালীন সর্বোচ্চ আলেমগণের কাছে তাঁর চিন্তাভাবনা প্রকাশ করা এবং আলেমগণকে তাঁর মতের সপক্ষে একত্রিত করা।

জনগণ ও ইসলামের উপর সর্বাত্মক আক্রমণ

২৯ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন সম্ভ্রান্ত আলেম সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আল তাক্বাফীর মেয়েকে। কোমেই জীবন যাপন করতে থাকেন তিনি। ওদিকে রেজা শাহ দেশের মোট কৃষিজমির অর্ধেক নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নিয়ে সাধারণ কৃষকদের দাসে পরিণত করলো। এছাড়াও নানাভাবে চলতে থাকলো জনগণের উপর অত্যাচার নির্যাতন। তুরস্ক থেকে ঘুরে এসে সেক্যুলার কামাল আতাতুর্কের অনুকরণে ইরানেও ইসলামকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করলো এই শাহ। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো, নিষিদ্ধ হলো জুমার খুৎবা ও কারবালার শোকসভা। আলেমগণের পাগড়ি পরার উপরেও জারি হলো নিষেধাজ্ঞা। দাড়ি রাখলে ট্যাক্স দিতে হতো। বাতিল হলো হিজরী ক্যালেন্ডার। স্কুলগুলোয় বন্ধ করা হলো ইসলামী শিক্ষা। কোথাও কুরআন শিক্ষা দেয়া যেত না। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের বাংলাদেশে এখন অনেকটা উপরোক্ত অবস্থারই সৃষ্টি হয়েছে। যাহোক, এসবের মাঝেই রেজা শাহ তার ছেলে মুহাম্মাদ রেজা পাহলভীকে শাসনভার গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত করছিলো। একইসময়ে যার ভবিষ্যৎ শত্রু ইমাম খোমেনী তখন জিহাদের এক নীরব প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ধর্মীয় নগরী কোমের এক মাদ্রাসায়। আলেমগণের মাঝে সীমাবদ্ধ সেই বিপ্লব ছিলো ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রথম ধাপ।

কোমে ইমামের জীবন

রেজা পাহলভীর শাসনকাল থেকেই কোমের আলেমগণ অত্যাচার-নির্যাতন ও গ্রেফতারের সম্মুখীন হতে থাকেন। গ্রেফতার এড়াতে তাঁরা প্রায়ই ভোরে পালিয়ে যেতেন মাদ্রাসা থেকে, আবার সন্ধ্যায় ফিরে আসতেন। রেজা পাহলভীর বাহিনী মাঝে মাঝে আলেমদের থানায় নিয়ে যেত। পাগড়ি পরায় তো নিষেধাজ্ঞা ছিলোই, উপরন্তু আলেমগণের জোব্বা ছিঁড়ে তাদেরকে অপমান করা হতো। এর মাঝেই ইমাম খোমেনী যুবক বয়সে শিক্ষকতা শুরু করেন। অত্যন্ত মেধাবী ইমাম খুব দ্রুত সেখানে উচ্চস্তরের শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেই ক্লাস নেয়া শুরু করেন। একইসাথে তিনি তাঁর ওস্তাদগণের কাছেও শিক্ষা নিতে থাকেন তাঁদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
ইমামের আগমণের আগ পর্যন্ত ফায়জিয়া মাদ্রাসায় শরীয়তের শিক্ষাদানই চলতো বেশি। কিন্তু ইমামের বিশেষ আগ্রহ ছিলো নৈতিক শিক্ষার দিকে। বিশেষতঃ ডিসিপ্লিনের শিক্ষা, আত্মিক পরিশুদ্ধি, আধ্যাত্মিকতা – ইত্যাদি নিয়ে তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার ক্লাস নিতে শুরু করেন। এই ক্লাস বেশ অনেক বছর ধরে চলে। ৩০ জন ছাত্র থেকে শুরু করে তাঁর ক্লাসের জনপ্রিয়তা এতই বেড়ে যায় যে, হাজারের উপরে সিনিয়র-জুনিয়র আলেম তাঁর ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। ইমাম তাঁর ক্লাসে বলতেন :
আমরা কি কোনো শোক অনুষ্ঠানে এসেছি নাকি ? আপনারা আমাকে জটিল প্রশ্ন করুন। বিরোধিতা করুন। যেখানে শিক্ষককে কোনো জটিল প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় না, সেটা রিসার্চের জায়গা নয়, সেটা হয় শোক অনুষ্ঠান।”
ডিসিপ্লিন, আত্মিক পরিশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিকতা বিষয়ক শিক্ষক।

এভাবে রুহুল্লাহ খোমেনী হয়ে ওঠেন আলেমগণের মাঝে সবচেয়ে কমবয়েসী কিন্তু গভীর প্রজ্ঞাসম্পন্ন শিক্ষক। আত্মার পরিশুদ্ধি শিক্ষা দেবার পাশাপাশি ইমাম দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখতেন। তিনি ইরান ও ইরানের বাইরের তৎকালীন ইসলামী বিপ্লবীদের সাথে দেখা করেন। তাদের বিপ্লবের অব্স্থা ও প্রতিকূলতা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। এসময়ে ইমাম সাধারণ মানুষের মাঝে ইসলামী নেতৃবৃন্দ ও আলেমগণের প্রভাব বৃদ্ধি করতে তৎপর হন। যদিও সেটা ছিলো এমন এক সময়, যখন ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি প্রতিকূলতার সম্মুখীন।

সেসময়ে, অর্থাৎ প্রথম পাহলভী রাজা, রেজা পাহলভীর শাসনামলে আলেমদের নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব করার মত দৃঢ় ভিত্তি ছিলো না। সুতরাং ইমামের প্রথম বিপ্লবটা ছিলো আলেমগণকে শক্তিশালী করা; নিজেদের ভিতরে এবং জনগণের মাঝেও। আলেমগণের এক সভায় ইমাম বলেছিলেন :
আপনাদের খুৎবায় অবশ্যই রাজনৈতিক বিষয়ের আলোচনা থাকতে হবে। কারণ জুমার নামাজ হলো সম্পূর্ণরূপে একটি পলিটিকাল ইবাদত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের জুমার খুৎবাগুলোর সাথে মানুষের চাহিদার কোনো সম্পর্ক নেই। মুসলিম সমাজের চাহিদার প্রতিফলন নেই। মসজিদই হলো সেই জায়গা যেখানে পলিটিকাল ইস্যু উত্থাপিত হবে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা মসজিদকে মুসলমানদের স্বার্থ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে ফেলেছি।...”
কথাগুলো আমাদের দেশসহ বহু জায়গায় এখনও প্রযোজ্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও রেজা শাহের ছেলের ক্ষমতা গ্রহণ
মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভী ও রানী ফারাহ দিবা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো। ইরানের শাহ রেজা পাহলভী নাৎসি জার্মানির পক্ষ নিয়ে করুণভাবে পরাজিত হলো। শত্রুপক্ষ ইরানের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়তে শুরু করলো। তখন ১৯৪১ সাল। ব্রিটেন সিদ্ধান্ত নিলো রেজা শাহকে সরিয়ে ফেলতে হবে। তাদের পরিকল্পনা ছিলো রেজা শাহকে ইটালিতে নির্বাসনে পাঠিয়ে তার ছেলে মুহাম্মাদ রেজা পাহলভীকে রাজক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা। সেমতো তারা মুহাম্মাদ রেজা শাহকে ক্ষমতায় নিয়ে এলো। প্রসঙ্গতঃ বলতে হয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে নাক গলানোর এই স্বভাব ব্রিটেনের এখনো যায়নি, এবং ব্রিটেনসহ বড় বড় অন্যান্য শক্তি আজো বিশ্বের বহু দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে চলেছে।

শুরু হলো ইরানের সর্বশেষ শাহ মুহাম্মাদ রেজা পাহলভীর শাসন। তরুণ শাহ তখন ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি যে তারই শত্রু ইমাম খোমেনী ততদিনে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্র উৎখাতের বিপ্লব অর্ধেকটা শেষ করেছেন: আলেমগণ ইমামের নেতৃত্বে ভবিষ্যৎ বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন।
ইমামের বই প্রকাশিত হলো : কাশফ-আল-আসরার (রহস্য উন্মোচন)। এখানে তিনি শাহের তীব্র সমালোচনা করেন। সেইসাথে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় আলেমগণের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন। এই বইয়ে তিনি বলেন : “(ইসলাম) ধর্ম ও রাজনীতি (পলিটিক্স) আলাদা নয়। যারা ধর্ম থেকে রাজনীতিকে আলাদা করতে চায়, তারা না বোঝে পলিটিক্স, আর না তাদের আছে ধর্মের জ্ঞান।" ধর্ম থেকে রাজনীতিকে আলাদা করা পশ্চিমাদের ইচ্ছা বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

বেলায়েতে ফকীহ

ইমাম খোমেনী তাঁর বইয়ে তুলে ধরেন তাঁর যুগান্তকারী ধারণা : বেলায়েতে ফকীহ – ফিহাহবিদদের শাসন – Governance of jurists. তৎকালীন ইরানী আলেমগণকে এই ধারণায় আশ্বস্ত করা ছিলো তাঁর বিপ্লবের প্রথম সাফল্য। আগেই উল্লেখ করেছি যে তৎকালীন আলেমগণ পলিটিকাল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের বিরোধী ছিলেন নানা কারণে। সরকারী অত্যাচার ও হুমকি ছাড়াও তাঁদের পলিটিক্সে অংশগ্রহণ না করার আরেকটি বড় কারণ ছিলো চিন্তাগত। তাঁদের অধিকাংশই বলতেন যে, ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করবেন ইমাম মাহদী (.)। এটি আমাদের কাজ নয়। আমাদের কাজ কেবল মানুষকে শরীয়তসহ ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেয়া।
ইমামের প্রথম বিপ্লব ছিলো আলেমগণকে এই ধারণা থেকে বের করে এনে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানানো। "বেলায়েতে ফকীহ" নামক আলোচনায় তিনি ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে শাসনক্ষমতা অধিগ্রহণ করার আহবান জানান। তিনি বলেন যে, ইসলামী আইনসমূহ শুধুমাত্র পাঠ করার জন্য দেয়া হয়নি, বরং ইসলামী আইনসমূহ আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন কার্যকর করার জন্য। আর ইসলামী আইন কার্যকর ও প্রতিষ্ঠা করতে একটি ইসলামী সরকারের অপরিহার্য। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন লেকচারে ইসলামী রাষ্ট্র কেনো প্রতিষ্ঠা করতে হবে ও ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখা ও স্বরূপ কী, তা আলোচনা করেন। তাঁর এই বক্তব্যগুলো এতই বিখ্যাত হয়ে ওঠে যে, এগুলো পরবর্তীতে মুসলিম-অমুসলিম বিভিন্ন চিন্তাবিদের গবেষণার বস্তু হয়ে ওঠে।
ইমাম বলেন : বর্তমানে আমাদের মাঝে যে ইসলাম আছে, তা থেকে পলিটিক্সকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তারা ইসলামের মূল ভিত্তিকে বাদ দিয়ে দিয়েছে, আর বাকিটুকু আমাদেরকে দিয়েছে। একারণেই ইসলাম সম্পর্কে আমাদের (সমাজের) এই অজ্ঞতা। আমরা জানিই না ইসলামের মৌলিক অংশটা কী। যতদিন পর্যন্ত না মুসলমানরা ইসলামকে খুঁজে পাবে, ততদিন পর্যন্ত আমরা গৌরব অর্জন করতে পারবো না।...

কমিউনিস্টদের উত্থান
মাদ্রাসার সিলেবাসে দর্শন ও যুক্তিশাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত করেন।

১৯৫০ সালের দিকে ইরানে কমিউনিস্টদের উত্থান ঘটলো। মার্কসবাদের প্রচার চলতে লাগলো ব্যাপকভাবে। তথাকথিত জাতীয়তাবাদী পার্ট, তুদা পার্টি ইত্যাদি বামপন্থী দল নাস্তিক্যবাদী ধ্যান ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করার কাজে লেগে পড়লো। আর বিপরীতে ইরানের ইসলামপন্থী মহল লেগে পড়লেন তাদেরকে মোকাবিলা করতে। এটা অস্ত্রের যুদ্ধ ছিলো না, এ যুদ্ধ ছিলো মানুষের মস্তিষ্ক দখলের। এসময়ে ইমাম খোমেনী হাওজাগুলোতে (ধর্মশিক্ষা কেন্দ্রে) এক ইন্টেলেকচুয়াল বিপ্লব শুরু করেন। তিনি আলেমগণের পাঠ্যসূচীতে যুক্তিশাস্ত্র ও দর্শনকে অন্তর্ভুক্ত করেন। উদ্দেশ্য : মার্কসবাদী ও নাস্তিক্যবাদী দর্শনকে মোকাবিলা করা ও দূরীভুত করা। প্রসঙ্গত, ইরানের ধর্মীয় নগরী কোম-এর হাওজাগুলোতে আলেমগণ বছরের পর বছর ইসলাম নিয়ে জ্ঞান গবেষণা করে থাকেন। সেখানের সর্বশেষ পাঠ্যসূচী নিম্নরূপ, যা সমাপ্ত করতে ব্যক্তিভেদে ৩০-৪০ বছর লেগে যায়। ১. যুক্তিবিদ্যা, . উসুলে ফিকাহ, . ফিকাহ, . তাফসির-এ কুরআন, . উলুম-এ কুরআন, . ইলম-আল হাদীস, . ইলম-আর রিজাল, . ইতিহাস, . ধর্মতত্ত্ব (কালামশাস্ত্র), ১০. ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ, ১১. ইসলামী দর্শন, ১২. ইরফান (ইসলামী আধ্যাত্মিক ধারা)

অপরাপর আলেমগণের তুলনায় দর্শন ও যুক্তিশাস্ত্রে ইমামের অবস্থান ছিলো অনেক উঁচুতে। এছাড়াও ইরফানী শাখায় তিনি যে উচ্চ স্তরের জ্ঞানলাভ করেন, তা সমসাময়িক আলেমগণকে বিস্মিত করে। দর্শন সম্পর্কে ইমাম বলেন : দর্শন সার্বিকতা নিয়ে কথা বলে। যেমন, আল্লাহর কাছে বস্তুর আপেক্ষিকতা। পুরনো এবং নতুনের সম্পর্ক। আধ্যাত্মিক মানুষেরা এর কিছু বিষয় আমাদের সামনে এনেছেন। কিন্তু সেই মাত্রার সম্পর্কে পৌঁছানো...। যেটা এই আয়াতে বলা হয়েছে : “তোমরা যেখানেই থাকো তিনি তোমাদের সাথে আছেন” – এর অর্থ কী ? এই আয়াতের অর্থ কী যে "আমি তোমাদের ঘাড়ের রগের চেয়েও নিকটবর্তী” ? এই কাছে থাকা, নিকটবর্তী থাকার মানে কি এই যে দুজন মানুষ যেভাবে পরস্পরের কাছে থাকে ? নাকি এটা অন্যকিছু, যা আমাদের বোঝার ক্ষমতার বাইরে ?”
ইরফান বিষয়ে ইমামের ছিলো বিশেষ আগ্রহ।

হাওজার সিলেবাসে দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার অন্তর্ভুক্তি ইমামের এমন একটি অবদান, যা থেকে মুসলিম বিশ্ব বহুকাল উপকৃত হতে থাকবে। এভাবে তিনি নাস্তিক্যবাদী দর্শনকে ইসলামী দর্শন ও যুক্তিশাস্ত্র দিয়ে মোকাবেলা করেন।
যদিও ইমাম ইরফানের উপর বই লিখেছিলেন, কিন্তু তাঁর ইরফান (আধ্যাত্মিক ধারা) ক্লাসের লেকচারগুলো ছিলো অত্যন্ত গোপন, এবং তাঁর এই ক্লাসে দুইজনের বেশি ছাত্র থাকতো না একসাথে। এই গোপনীয়তার একটি কারণ সম্ভবতঃ এই যে, উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণা সাধারণ মানুষের কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। এছাড়া উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক চর্চা সকলের জন্য প্রয়োজনীয়ও নয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে ইমাম খোমেনী ইরফানের উপর ক্লাস নেয়া বন্ধ করে দেন।

তবে ইমাম আভ্যন্তরীণ বিরোধিতার সম্মুখীন যে হননি, তা নয়। অনেক আলেম তাঁর বিরোধিতা করেন এই যুক্তিতে যে, ইমাম খোমেনী ঐতিহ্য ভঙ্গ করছেন। দর্শন শিক্ষা ও পলিটিক্সে অংশগ্রহণ হাওজার (দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র) কাজ নয়। হাওজার কাজ শুধু উসুলে ফিকাহ শিক্ষা দেয়া। আসলে ইমাম খোমেনী বহির্বিশ্বে যেমন প্রতিরোধের সম্মুখীন হন, তেমনি তাঁকে অনেক সময় মুখোমুখি হতে হয় আলেমগণেরও। এভাবেই চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ইমামের বিপ্লব অগ্রসর হতে থাকে। এর মাঝে ১৯২৮ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে দর্শন, ইরফান, আত্মশুদ্ধি ও নৈতিকতার উপর ইমামের তেরটি বই প্রকাশিত হয়।

হাওজার সর্বোচ্চ নেতা

আয়াতুল্লাহ আবদুল করিম আল হায়েরী আল ইয়াজদি ছিলেন ইমামের আধ্যাত্মিক গুরু এবং কোমের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। ১৯৪৭ সালে তাঁর মৃত্যুর পর নতুন নেতার সন্ধান শুরু হলো। ইমাম খোমেনীর কার্যকরী ভূমিকার ফলে আয়াতুল্লাহ বুরুজারদী হাওজার পরবর্তী সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হওয়ার অনুরোধ মেনে নেন। আয়াতুল্লাহ বুরুজারদী ছিলেন সে অঞ্চলের মুসলমানদের অবিসংবাদিত সর্বোচ্চ নেতা। ইমাম খোমেনী তাঁরও একজন ছাত্র ছিলেন। আর এই সময়ে বিভক্তির আশঙ্কা করে ইমাম খোমেনী পলিটিকাল বিষয়ে কাজকর্ম বন্ধ রাখেন। আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ বুরুজারদী না বললে তিনি কোনো ধরণের পলিটিকাল কাজকর্ম করা থেকে বিরত থাকেন। তাঁর চিন্তা ছিলো যে আগে আলেমগণের ঘাঁটি হাওজাকে যথেষ্ট শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, এরপর পলিটিকাল ফিল্ডে প্রবেশ করতে হবে। এছাড়াও পলিটিকাল বিষয়ে হাওজা অংশগ্রহণ করলে আয়াতুল্লাহ বুরুজারদী বিতর্কিত হতে পারেন, এই আশঙ্কায় তিনি পলিটিকাল ব্যাপারে কার্যতঃ নীরব হয়ে যান সেসময়। কিন্তু প্রাজ্ঞ আয়াতুল্লাহ বুরুজারদী ইমাম খোমেনীকে নিয়োগ করলেন তাঁর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে। এছাড়াও তাঁকে দায়িত্ব দিলেন হাওজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পেয়ে ইমাম খোমেনী হাওজার সিলেবাসে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে সক্ষম হন।
এসমস্ত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ফায়জিয়া মাদ্রাসায় তাঁর শিক্ষকতা চলতে থাকে। সেইসাথে চালু রাখেন বই লেখা। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত আরবী ভাষায় তিনি ফিকাহ শাস্ত্রের উপর আরো কিছু বই প্রকাশ করেন।

ইসরাঈল রাষ্ট্রের জন্ম : মুসলিম বিশ্বে শয়তানের প্রাণভোমরা
অবৈধ যায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাঈল।

১৯৪৮ সালে ব্রিটেনসহ শয়তানি শক্তিগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফিলিস্তিনের একটা বড় অংশ জবরদখল করে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাঈল প্রতিষ্ঠা হলো। বিতাড়িত হলো ফিলিস্তিনিরা তাদের জন্মভূমি থেকে। শুরু হলো মুসলিম বিশ্বের এক নতুন ঈমানী পরীক্ষা : ফিলিস্তিন মুক্ত হবে কী ? প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস ফিরে পাবো কি ?
ইমাম খোমেনী প্রায়ই তাঁর লেকচারে ফিলিস্তিন মুক্ত করার সক্ষমতা অর্জনের কথা বলতেন। শাহাদাতে অনুপ্রেরিত করে ইমাম বলেছিলেন :
প্রতিটি কাজকেই আগে গভীর পর্যবেক্ষণ ও চিন্তা থেকে শুরু হতে হয়। আর যদি আমাদের ভিতরে দুর্বলতা থাকে, তাহলে আমরা কিছুই করতে পারবো না। নিজেদেরকে শক্তিশালী করুন। অন্তরকে দৃঢ় করুন। আল্লাহর রাহে নিজেকে উৎসর্গ করে দিন। সকল প্রার্থনাই আল্লাহর কাছে করা হয়, কারণ তিনিই শক্তির কেন্দ্র। দোয়াসমূহে বলা হয় আল্লাহর নিকটবর্তী হতে, কারণ তা আপনাকে শক্তি দেবে, যেহেতু সর্বশক্তিমান আল্লাহ আপনার সাহায্যকারী। যে আল্লাহকে আঁকড়ে ধরে, কীসে তার ভয় ! আপনারা যারা আল্লাহর নিকটবর্তী হতে চান, (দুনিয়ার) কোন শক্তিকে আপনারা ভয় করবেন ! আপনারা কি শহীদি মৃত্যুকে ভয় করেন ?? শাহাদাৎ কি ভয়ের বিষয় ?? আপনারা কি বন্দী হওয়াকে ভয় করেন ?? আল্লাহর রাহে জেলবন্দী হওয়া কি ভয়ের বিষয় ?? আপনারা নির্যাতনকে ভয় করেন ?? আল্লাহর রাহে নির্যাতিত হওয়ায় কোনো সমস্যা আছে ?”

শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলভীর স্বৈরশাসক হয়ে ওঠা

কোনো শাসক যতই একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে থাকে, ততই তার পতন ঘনিয়ে আসে – এটাই ইতিহাসের অলঙ্ঘনীয় নিয়ম। আর সেই নিয়তির দিকে এগিয়ে যেতে রেজা শাহ সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা অধিগ্রহণ করলো, পার্লামেন্ট ইলেকশানে হস্তক্ষেপ করলো এবং এভাবে গোটা রাষ্ট্রক্ষমতাকে কার্যতঃ এক স্বৈরাচারী রাজার অত্যাচারের হাতিয়ারে পরিণত করলো। এর তীব্র বিরোধিতা এলো আলেমগণের পক্ষ থেকে, আর হাওজা হয়ে পড়লো শাহের প্রধান শত্রু। এ প্রসঙ্গে ইমাম বলেন :
যখন শাহ সংবিধান বিকৃত করে ইসলামী কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করলো, আমরা তার বিরোধিতা করলাম। সকল ধর্মীয় নেতৃত্বই এর বিরোধিতা করলো। এর ফলে ইরানে অনেককিছু ঘটে গেলো শান্তিপূর্ণভাবেই। প্রোটেস্ট করা এবং ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে সমর্থন দেবার জন্য সারা ইরান থেকে মানুষ কোমের দিকে আসা শুরু করলো। আমি এই (পলিটিকাল) ইস্যুগুলো খুব সাবধানতার সাথে মোকাবিলা করতাম।”
কোমের দিকে ইসলামপ্রিয় গণমানুষের স্রোত দেখে ইরানের শাহ তার প্রধানমন্ত্রীকে পাঠালো কোমের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের সাথে আলোচনা করতে। আয়াতুল্লাহ বুরুজারদী এবং আয়াতুল্লাহ কাশানি উভয়েই ইমাম খোমেনীকে আলোচনার কাজে নিযুক্ত করলেন। শাহের প্রধানমন্ত্রী ইমামকে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করলো যে তারা শুধু সিনেটের মতামতের ভিত্তিতে শাহের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সংবিধান সংশোধন করছে, তারা ইসলামবিরোধী কিছু করছে না। ইমাম জবাবে বললেন : আমরা এটা হতে দেবো না।” প্রধামন্ত্রী জিজ্ঞাসা করলো, কেনো ? ইমাম জবাব দিলেন :
কারণ ভবিষ্যতে তোমরা এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করবে ইসলামী আইনকে নিষিদ্ধ করতে। তোমরা একটার পর একটা ইসলামী আইন নিষিদ্ধ করবে।”
ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রী ফিরে গেলো তেহরানে।

নিয়াভারান প্যালেস : আটটি প্রাসাদের মাঝে এটিতেই সর্বশেষ বসবাস করতো শাহ।
শাসনভার গ্রহণ করার পর প্রথমদিকে শাহ জনগণকে ক্ষেপাতে চাইতো না, কারণ তখন সে নতুন গদিলাভ করেছে। এজন্যে কাজকর্মে সাবধানতা অবলম্বন করার চেষ্টা করতো। সুতরাং সংবিধান ইস্যুতে পিছু হটলো শাহ। তাছাড়া সে সময়ে ইরানের তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট চলছিলো, যদিও তাদের ছিলো বড় বড় সব তেলকূপ। কিন্তু সেগুলো ছিলো সরাসরি ব্রিটেন ও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। সুতরাং জনগণ দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্র হচ্ছিলো, আর শাহ ও তার ঘনিষ্ঠজনেরাসহ সমাজের "এলিট” শ্রেণী আরো ধনী হচ্ছিলো। রাজধানী তেহরানে শাহের প্রাসাদের বাইরেই দেখা যেত দারিদ্র্যের দৃশ্য। সাধারণ মানুষ রাস্তায় তাঁবু খাটিয়ে থাকতো, আর শাহ তার বিলাসবহুল সব প্রাসাদকে আরো বিলাসী করে তুলছিলো। এর ফলে গণঅসন্তোষের কারণে বিক্ষোভ-বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠতে লাগলো।

শাহ কর্তৃক বিদ্রোহ দমন
নবাব সাফাভিকে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে শহীদ করা হয়।

শাহ মিথ্যা সংবাদ ও ছবি প্রচার করলো যে, তাকে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে। এই ছুতায় ইরানে শাহের বিরোধী দল, কমিউনিস্ট তুদা পার্টিসহ বিরোধী সকল মতের বড় বড় নেতাদের গ্রেফতার করা হলো। গ্রেফতার হলেন আয়াতুল্লাহ কাশানি-ও। কিন্তু বিরোধীদের একটি গ্রুপ সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে গেলো। তখন প্রেসিডেন্ট ছিলো সেক্যুলারপন্থী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক। এই সরকারের প্রধামন্ত্রীকে হত্যা করা হয় সে বিদ্রোহে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সেনাশাসন জারি করে আমেরিকায় পালিয়ে গেলো শাহ। দেশে ফিরে এসে নিজের আর্মির এক কমান্ডারকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিলো সে। এটা ছিলো ১৯৫৩ সালের ঘটনা, যার দায় সম্প্রতি আমেরিকা স্বীকার করে নিয়ে বলেছে যে, '৫৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোসাদ্দেক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পিছনে মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো।
যাহোক, আমেরিকার ইচ্ছায় শাহ পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো এবং মোটামুটিভাবে বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হলো। সেক্যুলার মোসাদ্দেককে জেলবন্দী করা হলো এবং আয়াতুল্লাহ নবাব সাফাভিকে অ্যারেস্ট করে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে শহীদ করা হলো। পিতা রেজা শাহের মতই আলেমদের উপর জুডিশিয়াল কিলিংসহ সবধরণের অত্যাচার চালিয়েছিলো মুহাম্মাদ রেজা শাহ পাহলভী।

তবে ১৯৫৩ সালের এই অভ্যুত্থান, যাতে গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোসাদ্দেক সরকারকে উৎখাত করা হয়, তা ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিলো। এই ঘটনায় ইরানের সাথে মার্কিন বন্ধুত্ব দৃঢ় হলো, এবং শেষমেষ ইরানের আর্মি হয়ে উঠলো মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী ও অপ্রতিরোধ্য বাহিনী। বিশ্বের মধ্যে পঞ্চম শক্তিশালী আর্মি। আর এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ হলো আরো দৃঢ়।

ইমামের পর্যবেক্ষণ
অনেক বিপ্লবকে ব্যর্থ হতে দেখছিলেন।

তৎকালীন ইরানের প্রায় সকল বিপ্লবী আন্দোলন-ই ইমাম তাঁর জীবনে প্রত্যক্ষ করেছেন। এগুলো প্রত্যক্ষ ও পর্যবেক্ষণ করা, সেইসাথে ইরানের বাইরের বিভিন্ন বিপ্লবী নেতার সাথে যোগাযোগ ও তাঁদের অভিজ্ঞতা-পর্যবেক্ষণ, ইত্যাদি ইমামের নিজস্ব বিপ্লবী চিন্তাধারাতে সহায়তা করেছিলো।
আয়াতুল্লাহ কাশানিকে বন্দী করা, আয়াতুল্লাহ নবাব সাফাভিকে শহীদ করা এবং এমনকি সেক্যুলার মোসাদ্দেকের বন্দী হওয়া – তিনটি বিপ্লব প্রচেষ্টার ব্যর্থতা সম্পর্কে ইমাম তাঁর পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেন। তাঁর মতে এসব বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ ছিলো জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপক অংশগ্রহণ, যা বিপ্লবকে রক্ষা করে – তার অভাব। একটা দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ যদি অর্জিত বিপ্লবকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত না থাকে, তবে অর্জিত বিপ্লব রক্ষা করা সম্ভব হয় না। নিরঙ্কুশ মুসলিম গণভিত্তিই হলো সফল ইসলামী বিপ্লবের ভিত্তি।

বিপ্লব ছড়িয়ে পড়লো এক মাদ্রাসা থেকে

ষাটের দশকে ইমামের বিপ্লব প্রকাশ্য হতে শুরু করলো। অর্থাৎ কোম নগরীর সর্ববৃহৎ মাদ্রাসা, ফায়জিয়া মাদ্রাসা থেকে বিপ্লব আত্মপ্রকাশ করলো। এটাকে বিপ্লবের দ্বিতীয় ধাপ বলা যেতে পারে। প্রথম ধাপ ইমাম তাঁর বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছিলেন ইতোমধ্যেই : আলেমগণের কাছে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব তুলে ধরে তাঁদের অধিকাংশকে একত্রিত করেছিলেন। এছাড়াও গুরু আয়াতুল্লাহর বুরুজারদীর অনুসরণে শিয়া-সুন্নি বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্যও কাজ করেছিলেন আলেমগণের মাঝে।
যাহোক, ইমামের হাজার হাজার ছাত্রের মাঝে বিপ্লবে যাঁদের নাম অগ্রভাগে ছিলো, তাঁরা ছিলেন আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহারি, আয়াতুল্লাহ বেহেশতি, আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী এবং হুজ্জাতুল ইসলাম হাশেমী রাফসানজানি। ইমামের নেতৃত্ব ও পরিচালনায় শাহের বিরুদ্ধে বিপ্লব পরিণত হলো ইসলামী জিহাদে। যখন দুনিয়ার অন্যান্য জায়গায় বামপন্থি আন্দোলন চলছে এবং বিজয়ীও হচ্ছে, তখন ইরানে ইমাম খোমেনীর পরিচালিত ইসলামী বিপ্লব ছিলো সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।

১৯৬১ সাল। দেশের বড় বড় তেলকূপগুলো সব আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছে। ৫০ বছরে ব্রিটেন যতটা চুরি করতে পারেনি, মাত্র দশ বছরে তার বহুগুণে তেল চুরি করে নিয়ে গেলো আমেরিকা। ৩৪০ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত তেল। সেইসাথে আর্মিকে শক্তিশালী করতে যে বিপুল অর্থব্যয় করে শাহ, তাতে দেশের আর্থিক রিজার্ভ অত্যন্ত কমে আসে। ইমাম বললেন :
যদি এটা ত্রিশ বছর ধরে চলে, তাহলে আমাদের আর কোনো তেলকূপই অবশিষ্ট থাকবে না। আমাদের জনগণের কোন তেল থাকবে না, কৃষিও থাকবে না। জনগণ ভিক্ষুকে পরিণত হবে। অর্ধেক জনগণ এখন পথে বসেছে, আর বাকিরাও বসবে, তাদের কোনো রিজার্ভ থাকবে না। আমরা যদি এই লোককে (শাহকে) আরো সময় দিই, তাহলে সে আমাদের গৌরব-মর্যাদাকে শেষ করে ছাড়বে।”

অত্যাচার, নির্যাতন, অপশাসন, দূর্নীতি
মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভী, রানী ফারাহ দিবা এবং রাজপুত্র।

মুহাম্মাদ রেজা শাহ পাহলভীর অপকর্মের ফিরিস্তি দিলে আলাদা একটি বই-ই হয়ে যাবে। একদিকে দেশের সম্পদ আমেরিকার হাতে তুলে দেয়া ও সামরিক বাহিনীর পিছনে বিপুল ব্যায়ের মাধ্যমে জনগণকে পথে বসানো, আরেকদিকে মিশরের সেক্যুলার জামাল আবদুল নাসের এর ভিশন অনুযায়ী ইরাকের সাথে মৈত্রীচুক্তি, অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাঈলের সাথে গোপন চুক্তি, সিআইএ ও মোসাদ (যথাক্রমে আমেরিকান ও ইসরাঈলী গোয়েন্দা সংস্থা) এর কাছে নিবর্তনমূলক বাহিনী সাভাকের প্রশিক্ষণ, যার কাজ ছিলো সচেতন মানুষদের ধরে গুম-খুন-নির্যাতন করা – ইত্যাদি সবই আসলে শাহের পতনকে ত্বরান্বিত করছিলো। ইমাম খোমেনী তাই তাঁর এক ভাষণে শাহকে বলেছিলেন :
সেই দিন পর্যন্ত অপেক্ষা কোরো না, যেদিন তোমার পতনে এদেশের মানুষ উল্লাস করবে।”
ইমামের সেই ভবিষ্যৎবাণীই সত্য হয়েছিলো শেষ পর্যন্ত।
শাহের বশংবদ আর্মি।

মার্কিন ট্রেনিং, অস্ত্রসহায়তা, ইত্যাদির মাধ্যমে ইরান ব্যাপক সামরিক শক্তি অর্জন করলো এবং গালফ এর পুলিশ হিসেবে খ্যাত হলো। চুক্তি হলো যে, ইরানের যেকোনো বিপদের সময়ে মার্কিন সেনাবাহিনী সেখানে প্রবেশ করতে পারবে। বিজয়ের পর দেশে ফিরে এই আর্মির উদ্দেশ্যে ইমাম বলেছিলেন :
আমরা আমাদের আর্মিকে স্বাধীন দেখতে চাই। ওহে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, তোমরা কি চাও না স্বাধীন থাকতে ? তোমরা কি স্বাধীন কর্নেল হিসেবে থাকতে চাও না ? তোমরা কি অন্য দেশের সহযোগী হিসেবে থাকতে চাও ? আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি, জনগণের বাহুবন্ধনে ফিরে আসো। আর জনগণ যা বলে, তা-ই বলো। বলো যে আমাদের অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে। জনগণও তা-ই চায়। আর্মির উচিত না আমেরিকার অনুগত থাকা। আমরা এটা তোমাদের ভালোর জন্যই বলছি। সুতরাং তোমরাও নিজেদের জন্যে একথা বলো। বলো যে তোমরাও তা-ই চাও।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিপ্লবের পরপর দেশে ফিরে ইমাম যখন এই ভাষণ দেন, তখনও ইরানি আর্মি জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ত্যাগ করেনি, হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছিলো।

রুহুল্লাহ খোমেনী থেকে আয়াতুল্লাহ খোমেনী, অতঃপর সর্বস্তরের মানুষের কাছে ইমাম খোমেনী হয়ে ওঠা

১৯৬১ সালে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ বুরুজারদীর মৃত্যু কোমের হাওজাকে এক ঐতিহাসিক টার্নিং পয়েন্টের মুখোমুখি করলো। শাহ ভাবলো, আয়াতুল্লাহ বুরুজারদীর মৃত্যু কোমের হাওজাকে দুর্বল করে দিয়েছে। সুতরাং যেভাবে সে তিনজন গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহী আয়াতুল্লাহ কাশানি, আয়াতুল্লাহ নবাব সাফাভি ও সেক্যুলার মোসাদ্দেককে পথের কাঁটা হিসেবে সরিয়ে দিয়েছিলো, সেভাবেই তার সর্বশেষ পথের কাঁটা ইমাম খোমেনীকে সরিয়ে দেবার কূপমণ্ডূকতায় লিপ্ত হলো। হযরত মাসুমার (রহ.) মাজারে গিয়ে শাহ এক দীর্ঘ বক্তৃতায় বললো, এতদিন তার পথে এক দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যক্তি ছিলো, এখন সে চলে গিয়েছে। সুতরাং শাহ তার পিতার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেব। (অর্থাৎ আয়াতুল্লাহ বুরুজারদীর মৃত্যুতে সে আবার ইরানকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করবে, যা তার পিতার স্বপ্ন ছিলো।) সে দম্ভোক্তি করে বলেছিলো : “কেউ আমাকে থামাতে পারবে না। কেউ আমার পথে এসে দাঁড়াতে পারবে না।” কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালার পরিকল্পনা ছিলো ভিন্ন, যা মুশরিক শাহের অনুধাবন করার কোনো ক্ষমতাই ছিলো না।

সুতরাং অপরিণামদর্শী শাহ তার স্বৈরশাসনকে দৃঢ় করলো এবং মুসলমানদের উপর সেক্যুলারিজমকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। সেমতো বছরখানেক পরেই নির্বাচনে ভোটার ও প্রার্থীর মুসলমান হবার শর্তটি সংবিধান থেকে উঠিয়ে দিলো। এছাড়াও কুরআন হাতে শপথের নিয়মও তুলে দেয়া হলো। ইমাম খোমেনীসহ বড় বড় আলেমগণ শহীদ আয়াতুল্লাহ হায়েরী আল ইয়াজদির ছেলের বাসায় জরুরি বৈঠকে বসলেন। প্রার্থীদের মুসলমান হওয়ার শর্ত উঠিয়ে দেয়ায় বাহাই সম্প্রদায়ের লোকেরা রাষ্ট্রের অ্যাডমিনিস্ট্রেশানে প্রবেশ করবে বলে তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করলেন এবং সংবিধান সংশোধনের বিরোধিতা করলেন। ইমাম লিখলেন :
ধর্মীয় নেতা ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা কি কখনো সভ্যতার অগ্রগতি এবং বৈজ্ঞানিক উন্নতির সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন ? ... কখনো কি এমন হয়েছে যে তোমরা একটা ফ্যাক্টরি বানাতে চেয়েছো আর তারা তোমার বিরোধিতা করেছে ? তোমরা স্পেসে ঘুরে বেড়ানোর মেশিন তৈরী করতে চেয়েছো আর ধর্মীয় নেতাগণ তোমার পথে এসে দাঁড়িয়েছে ? আমাদের দাবী হলো নারীদের ধ্বংস ও ব্যাভিচারের পথে টেনে আনা হবে না। গত ২০ বছর যাবৎ হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আছে। মানুষ ও দেশের জন্য তাতে কী লাভ হয়েছে ? এই খেলা বন্ধ করো, কুরআন ও ঐশী ধর্মের উপর থেকে তোমার হাত উঠিয়ে নাও (হস্তক্ষেপ করা বন্ধ করো), এবং ডেভেলপমেন্ট, সিভিলাইজেশান ইত্যাদির নামে দেশের সংবিধান লঙ্ঘন কোরো না ।"
উত্তরে শাহ লিখলো, তোমরা আলেমরা সাধারণ মানুষকে শরীয়ত শিক্ষা দাও, কিন্তু পলিটিক্সের মধ্যে নাক গলাতে এসো না। আর এই বক্তব্যে আয়াতুল্লাহগণকে অপমানজনকভাবে সম্বোধন করা হয়েছিলো।

ইমাম খোমেনী তক্ষুণি ছাত্রদেরকে বিপ্লবী কমিটি তৈরী করার নির্দেশ দিলেন। এই কমিটির দায়িত্ব ছিলো ইমামের বক্তব্য প্রচার ও বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা। প্রথমেই প্রচার করতে বলা হলো আয়াতুল্লাহগণকে অপমান করে দেয়া শাহের চিঠি। এই চিঠির অসংখ্য কপি ছড়িয়ে দেয়া হলো মানুষের মাঝে। এই চিঠিকে মানুষজন ওলামাগণের উপর সরাসরি আঘাত ও অপমান হিসেবে দেখলো। মুহুর্তের মধ্যে ইরানের রাস্তায় বিক্ষুব্ধ জনতা নেমে এলো। ইমাম কঠোর ভাষায় শাহকে হুঁশিয়ার করলেন :
(শাহ !) যেহেতু তুমি আমাদেরকে বলেছো সাধারণ মানুষকে শিক্ষাদান করতে, সুতরাং আমি সধারণ মানুষকে বলছি – হে জনগণ ! (শোনো।) সেইসাথে তোমার সরকারকেও বলছি : অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে তুমি সিদ্ধান্তা নিয়ে ফেলেছো ধর্মীয় নেতাগণের উপদেশকে সম্মান ও তোয়াক্কা করবে না। ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হলো জাতির খুঁটিস্বরূপ, জনগণের আশ্রয়। আর তুমি মনে করছো যে তুমি কুরআন, দেশের সংবিধান এবং মুসলমানদের অনুভূতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে টিকে থাকতে পারবে। কুরআনের শিক্ষাকে উপেক্ষা ও অপমান করার পরিণতির ব্যাপারে আমি তোমাকে সতর্ক করছি। যদি সতর্ক না হও, তাহলে মুসলিম স্কলার এবং ধর্মীয় নেতাগণ তা-ই করবেন, যা করা দরকার।”

ছয়মাসেও বিক্ষোভ-সভা-সমাবেশ-মিছিল থামলো না, বরং যেনো বেড়েই চললো। এর মূল কারণ ছিলো নাস্তিক্যবাদ দ্বারা ইসলাম-প্রিয় মানুষের চিন্তা-চেতনার উপর আঘাত করা।
এবার ইমাম খোমেনীকে বাদ দিয়ে অন্যান্য আলেমগণের উদ্দেশ্যে টেলিগ্রাম করলো শাহ। অথচ তখন মিছিলে মিছিলে শুধু ইমাম খোমেনীর নাম ও ছবি। যাহোক, সেই টেলিগ্রামে আলেমগণকে মিথ্যা কথা বলা হলো। শাহ তার টেলিগ্রামে বলেছিলো যে সংবিধানের সংশোধনীগুলো বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ইমাম খোমেনী বললেন যে না, সংশোধনীগুলো আসলে বাতিল হয়নি। আর যদি হয়েই থাকে, তাহলে তা সরকারীভাবে ঘোষণা করতে হবে। শাহ বাধ্য হলো সরকারী গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে সংশোধনী বাতিলের কথা প্রকাশ করতে।

এভাবে, শাহের অপকর্মগুলোর সমালোচনা, জনগণকে তা জানানো এবং শাহকে আলেমগণের বক্তব্য মানতে বাধ্য করা – ইত্যাদির মাধ্যমে ইমাম খোমেনীর প্রকাশ্য বিপ্লব প্রাণ পেতে শুরু করলো। আর খোমেইন প্রদেশের রুহুল্লাহ খোমেনী হয়ে উঠলেন অবিসংবাদিত ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনী, আর সর্বস্তরের জনসাধারণের মুখপাত্র – ইমাম খোমেনী।

শাদা বিপ্লব (White Revolution)
মার্কিন প্রভু জিমি কার্টারের সাথে ইরানের শাহ

শাহের পরপর কয়েকটি সরকার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সঙ্কট ও অচলাবস্থা নিরসনে ব্যর্থ হলো। ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শাহ ১৯৬৩ সালে "শাদা বিপ্লব” বা white revolutoin এর ঘোষণা দিলো, যা কার্যত ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। মার্কিন দালাল হিসেবে জনগণকে শোষণ করা ও দেশের তেলসম্পদ আমেরিকার হাতে তুলে দিয়ে জনগণকে শাদা বিপ্লবের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে শাহ কার্যতঃ তার পতনকেই ত্বরান্বিত করছিলো। বিপ্লবের পরে ইমাম খোমেনী তাঁর এক ভাষনে বলেছিলেন :
যখন আমি পত্রিকায় সেই ছবি দেখলাম যে মুহাম্মাদ রেজা পাহলভী আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সামনে অসহায় বাচ্চার মত দাঁড়িয়ে আছে, আর সে (মার্কিন প্রেসিডেন্ট) তার (শাহের) দিকে অশ্রদ্ধা ভরে তাকিয়ে আছে – আল্লাহ জানেন আমার কী অনুভুতি হয়েছিলো। আল্লাহ জানেন আমার কেমন লেগেছিলো। সম্ভবত এখনও সেই তিক্ততা রয়ে গিয়েছে। আমাদের অবস্থা কী দাঁড়াতো, যখন আমাদের লোক (শাসক) বলে : “আমিই সব, আমি দেশকে এই করবো সেই করবো, আমরা জাপানের চেয়েও এগিয়ে যাবো।” (অথচ) আমি তাকে দেখলাম এক দুর্বল এবং মান সম্মানহীন লোক হিসেবে, যে কিনা আমেরিকায় যায়, আর তারপর অনুমতি পেলে সেই প্রেসিডেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আর সেই প্রেসিডেন্ট তার দিকে তাকায়ও না, বরং বিরক্তিভরে তাকায়।”

শাদা বিপ্লবের নামে শাহের লোক দেখানো ট্রাক্টর চালানো, কিছু কৃষককে তাদের জমি ফেরত দেয়া, ইত্যাদি কাজের আড়ালে সে আসলে কৃষিকে ধ্বংস করছিলো, যেনো আমেরিকার জন্য বাজার তৈরী করা যায়। প্রসঙ্গতঃ, বাংলাদেশেও ঘটে চলেছে অনুরূপ ঘটনা : কোনো নির্দিষ্ট দেশের জন্য বাজার তৈরী করার লক্ষ্যে নিজস্ব শিল্প ধ্বংস করা। যাহোক, বিপ্লবের পর দেশে ফিরেই বেহেশতে যাহরা কবরস্থানে প্রথম ভাষণ দেন ইমাম খোমেনী। তখন তিনি এই শাদা বিপ্লবের প্রকৃত চেহারা সম্পর্কে বলেছিলেন :
তারা ভেবেছিলো (বলেছিলো) যে কৃষি সংস্কার ও কৃষক পুনর্বাসনের নামে, কৃষকদের দারিদ্র থেকে উদ্ধার করার নামে তারা কৃষকদের রক্ষা করেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন পর, এখন তোমার এই সংস্কারের ফলস্বরূপ কৃষকই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, এবং সামগ্রিকভাবে আমাদের কৃষিই শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন দেশ সবদিক দিয়ে বাইরের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে। সুতরাং, মুহাম্মাদ রেজা পাহলভী এই পদক্ষেপ নিয়েছিলো আমেরিকার জন্য এদেশে বাজার তৈরী করতে, এবং চাল-গমসহ সবকিছুর জন্য আমেরিকার উপর নির্ভরশীল হতে। কিংবা ইসরাঈল থেকে ডিম কেনা, আমেরিকা থেকে যন্ত্রপাতি কেনার উদ্দেশ্যে। তাই এই সংস্কারের নাম করে সে যা যা করেছিলো, তার সবই ছিলো দুর্নীতি। এই কৃষি সংস্কার এদেশকে চপেটাঘাত করেছে। হয়তো আমরা বিশ বছরেও এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবো না।”

তো শাহ যখন শাদা বিপ্লব ঘোষণা করলো, এর প্রকৃত চেহারা বুঝতে পেরে ইমাম খোমেনী আলেমগণকে ডেকে বলেন যে এখন সময় এসেছে দৃঢ় শপথ নিয়ে সরাসরি শাহের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করার। সুতরাং কোম থেকে জারি করা হলো এক ফতোয়া। এই ফতোয়ায় শাহের কর্মকাণ্ডকে ইসলাম বিরোধী ও সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষণা করা হয়। জনগণকে রাস্তায় নামিয়ে আনার জন্য এই ফতোয়াটিই যথেষ্ট ছিলো। শহরগুলোর সব দোকানপাট স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ রাখা হলো। লাখো নারী-পুরুষের মিছিলের এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হলো।

জনগণের সরাসরি বিপক্ষে যাবার পরিবর্তে শাহ তার শাদা বিপ্লবের দফাগুলির উপর এক গণভোটের প্রস্তাব করলো। সেইসাথে এ-ও বললো যে সে কোমে গিয়ে ধর্মীয় নেতাদের সাথে দেখা করবে পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য। জবাবে কোম নগরীতে শাহের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন ইমাম খোমেনী। এই সংবাদও সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো। এসময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন ইমামের ছাত্ররা, যেনো ইমামের বক্তব্য দেশের মানুষের কাছে বিভিন্নভাবে পৌঁছে দেয়া যায। শাহের দুঃশাসনের প্রতি গণ-অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য ইমাম আরেকটি কাজ করলেন এ সময়ে। ইরানে নওরোজ উৎসব, অর্থাৎ নববর্ষ পালন অত্যন্ত ঐতিহ্যগত একটি সার্বজনীন অনুষ্ঠান। কিন্তু সে বছর নববর্ষের দিনকে ইমাম খোমেনী শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করলেন। কৌশল হিসেবে নিষেধ করেছিলেন রমজান মাসের খুৎবা। সুতরাং লোকজন মসজিদে গিয়ে সবকিছু বন্ধ পেলো। এতে এই অনুভূতি মানুষের মাঝে আরো প্রকট হলো যে, শাহ ইসলামী কর্মকাণ্ড বন্ধের ষড়যন্ত্র করছে।

ফায়জিয়া মাদ্রাসায় কারবালার ঘটনার পুনরাবৃত্তি
মাদ্রাসায় ঢুকে ছাত্রদের হত্যা করে শাহের বাহিনী।

ইরানি জনগণ হাজার বছর ধরে নওরোজ অনুষ্ঠান পালন করে আসছে। কিন্তু সেবার নওরোজের দিনে মানুষ শোক দিবস পালন করলো। যেনো ইরানের ইতিহাসের হাজার বছরের সকল শাসকের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে আবির্ভূত হলেন ইমাম খোমেনী। গোটা ইরানজুড়ে যেদিন আনন্দ উৎসব চোখে পড়ার কথা, সেদিন দেখা গেলো উল্টো দৃশ্য। এ ছিলো শাহের শাসনক্ষমতার উপর এক সরাসরি আঘাত। এ ছিলো হাজার বছরে রাজতন্ত্রের উপরে ইসলামী নেতৃত্বের বিজয়। ছিলো বেলায়েতে ফকীহ, অর্থাৎ ফিকাহবিদের শাসনের পূর্বাভাস, যার ছক ইমাম এঁকেছিলেন আরো প্রায় ত্রিশ বছর আগে। শাহের টনক নড়লো। অসহিষ্ণু শাহ বেছে নিলো গণহত্যার পথ।

২২শে মার্চ, ১৯৬৩ সাল। ইরানী নববর্ষের দ্বিতীয় দিন। হযরত ইমাম জাফর সাদেক (.) এর শাহাদাৎ দিবস উপলক্ষে শোকসভার আয়োজন করা হয়েছে। মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে ইসলামপ্রিয় মানুষের ভীড়ে তিল ধারণের জায়গা নেই। এমন সময় সেখানে সামরিক যান, বাস, ট্যাক্সি ইত্যাদিতে করে পৌঁছে গেলো মেশিনগানে সজ্জিত শাহের সন্ত্রাসী সাভাক বাহিনী সহ বিভিন্ন বাহিনী। ইসলামবিরোধী শ্লোগান দিয়ে তারা নিরস্ত্র মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত করলো ফায়জিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গন। আহতদের যারা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তাদেরও জোরপূর্বক বের করে দেয়া হলো। এ যেনো কারবালার ঘটনার-ই পুনরাবৃত্তি ! শাহের বাহিনীর এই নৃশংসতার খবর ইমামের কানে পৌঁছলে তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে জনতার উদ্দেশ্যে বলেন :
আপনারা শান্ত থাকুন। আপনারা এমন সব পবিত্র ধর্মীয় নেতার অনুসারী, যাঁরা এর চাইতে আরো বেশী নির্যাতন ভোগ করেছেন। যারা এ ধরণের দৌরাত্ম্য ও নির্যাতন চালায় শেষ পর্যন্ত তা বুমেরাং হয়ে তাদের কাছেই ফিরে যায়। ইসলামের ইজ্জত-কদর বজায় রাখার জন্য আপনাদের অনেক ধর্মীয় নেতাই মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁরা এর দায়িত্বভাবর এখন আপনাদের উপর ন্যস্ত করে গেছেন। সুতরাং, তাঁদের পবিত্র উত্তরাধিকার হিফাজত করার দায়িত্ব আপনাদেরই।”

সেদিন রাতে ইমামের বাসায় যখন তাঁর ছাত্র ও আলেমগণ জড়ো হলেন, তিনি তাদেরকে সাহস দিলেন। শাহকে উদ্দেশ্য করে বললেন :
আমি নিজেকে প্রস্তুত করেছি। প্রস্তুত করেছি আমার দেহ ও এই বুক – তোমার বর্ষা ও তীর গ্রহণ করার জন্য। ইন-শা-আল্লাহ, আমি তোমার কাছে মাথা নত করবো না। এবং আমি তোমার দুঃশাসন ও নির্যাতনের মুখে পিছু হটবো না কিংবা আত্মসমর্পনও করবো না। আমি তোমার দেশ ও ইসলামবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডের ব্যাপারেই চুপ করে থাকবো না। এবং যতদিন আমার হাতে কলম আছে, আমি ততদিন তোমার মোকাবিলায় ফতোয়া জারি করবো এবং লিফলেট লিখতে থাকবো।”

ইমামের গ্রেফতার : শুরু হলো এক দীর্ঘ বিপ্লব

শাহ কর্তৃক ইরানে অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাঈলের দূতাবাস চালুর ঘোষণাকে ইমাম অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিলেন। ফিলিস্তিন ইস্যু ইমামের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আর এই শাহ সেই ইসরাঈলের দূতাবাস চালু করার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের উপর ইহুদি নিপীড়নকে বৈধতা দিলো।
জালিম শাহের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আলেমগণের ওয়াদা নিলেন।

ইমাম তাঁর বাসভবনে আলেমগণকে ডাকলেন। আশুরার খুৎবায় শাহের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে সকলে একমত হলেন।
৫ই জুন, ১৯৬৩ সাল। আশুরার বক্তৃতায় ইমাম খোমেনী বললেন :
(হে শাহ !) তোমাকে ইসলামের নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হবে। এবং ধর্মীয় নেতাগণের কথা শুনতে হবে। তাঁরা এদেশের ভালো চান। ইসরাঈল থেকে ফিরে আসো, কারণ ইসরাইলের পক্ষে থাকাটা তোমার কোনোই কাজে আসবে না। দুর্দশাগ্রস্ত, নীচ ! তোমার জীবনের ৪৫ বছর পার হয়ে গিয়েছে, আজ পর্যন্ত কখনো একটু গভীরভাবে চিন্তা করো নাই, তোমার কাজের প্রতিক্রিয়া ভেবে দেখো নাই, অতীত থেকে শিক্ষা নাও নাই। তারা তোমাকে যে মিথ্যাবাদিতা ও ধোঁকাবাজি শিক্ষা দিচ্ছে, তা শুনো না। নির্বোধ কে ? অসহিষ্ণু কে ? ইসলাম আর আলেমগণ, নাকি তুমি আর তোমার শাদা বিপ্লব ? কীসের এই বিপ্লব ? এর গোড়া কোথায়, তা বলো। উন্মোচন করো। তুমি কতদিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চাও ? তুমি কতদিন মানুষকে ভুলপথে চালিত করতে চাও ?”

পাহলভী রাজবংশের ইতিহাসে আর কেউ কখনো শাহকে এভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন নাই। ইমাম খোমেনীই সেই ব্যক্তি ছিলেন, যিনি অত্যাচারী শাসককের তার গর্জনের চেয়েও বহুগুণ বেশি শক্তিতে প্রতি-উত্তর করেছিলেন। সেটা এমন এক সময়, যখন শাহের রাজনৈতিক বিরোধিতা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট ছিলো না। এমনই এক সময়ে আয়াতুল্লাহ খোমেনী তার বিরুদ্ধে কার্যতঃ যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। তাঁর আশুরার ভাষণ ম্যাজিকের মত কাজ করলো।
স্বৈরশাসক শাহ তার ক্ষমতার হুমকি হিসেবে দেখলো ইমাম খোমেনীকে। গভীর রাতে ইমাম গ্রেফতার হলেন। খবর ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র। সকালে রাস্তায় নেমে এলো দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ, তাদের অবিসংবাদিত নেতা ইমাম খোমেনীর জন্য। এর শুরু হলো শাহের অত্যাচারী বাহিনীর গুলি। সেনাবাহিনী, নিয়মিত পুলিশ ও মোসাদ-সিআইএর হাতে বর্বরতার বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত সাভাক বাহিনী একযোগে হামলা করলো। খোদ তেহরানেই ১৫,০০০ এর উপরে মানুষ শাহাদাৎ বরণ করেন। কোম নগরীতে শহীদ করা হয় চার শতাধিক লোককে। প্রথমদিকে তারা নিয়ম মেনে পায়ে গুলি করছিলো। এরপর সরাসরি মাথায়। যে দৃশ্য আমরা বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করছি আজ। এমনকি সেসময়ে শাহের জারি করা সামরিক শাসন এতটাই বর্বর হয়ে উঠেছিলো যে, মাথায় গুলি করতে যে সেনা অস্বীকৃতি জানাবে, সেই সেনাকে গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দিলো শাহ। হেলিকপ্টার থেকে পর্যন্ত বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ করা হলো। হত্যাযজ্ঞ শেষে হেলিকপ্টারযোগে অসংখ্য লাশ গুম করার জন্য তুলে নিয়ে কোমের নিকটবর্তী লবণ হ্রদে ফেলে দিয়েছিলো জালিম বাহিনী। সেই লবণ হ্রদ এখন শহীদদের স্মৃতিচারণের জায়গা হিসেবে সংরক্ষিত আছে।

ইমামের গ্রেফতার কেবল বিপ্লবকেই বেগবান করলো। বাণিজ্যিক ধর্মঘট, রাস্তায় সভা-সমাবেশ বিক্ষোভ, ইত্যাদি চলতে লাগলো অব্যাহতভাবে। নয় মাসের মাথায় শাহ বাধ্য হলে ইমামকে মুক্তি দিতে, যদিও প্রাথমিকভাবে তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলো।

যে নয় মাস ইমাম বন্দী ছিলেন, তখন হাওজায় আরেকটি ধারার সৃষ্টি হয়, যারা বিপ্লবের সফল হওয়ার চান্স নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এটাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চেয়েছিলো শাহ। কিন্তু মুক্ত হবার পরপরই ইমাম সেই আগের মত করেই কঠোর ভাষায় শাহের সমালোচনা শুরু করেন। এবং হাওজায় সম্ভাব্য বিভক্তিকে ঐক্যে পরিণত করেন। কোমের আজম মসজিদে গিয়ে ইমাম এক হেকমতপূর্ণ ভাষণ দিলেন। বললেন :
কেউ যদি আমাকে অপমান করে কিংবা আমাকে চপেটাঘাত করে, আল্লাহর কসম ‍! আমি চাইবো না আর কেউ এসে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াক আমার পক্ষ নিয়ে। আমি তা গ্রহণ করবো না। আমি জানি যে কিছু লক্ষ্য, হোক তা উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিংবা অজ্ঞতাপ্রসূত, এসব লক্ষ্য হলো সমাজে বিভক্তি সৃষ্টির জন্য। কিন্তু আমার পক্ষ থেকে আমি সকল ধর্মীয় নেতৃত্বের হস্ত চুম্বন করবো। তা তিনি নাজাফ, মাশহাদ তেহরান কিংবা যেকোনো জায়গারই হোন না কেনো। আমি ইসলামের সকল উলামার হস্ত চুম্বন করি (সম্মান করি)। আমাদের লক্ষ্য এসবের উর্ধ্বে। আমি বিশ্বের সকল মুসলিমের উদ্দেশ্যে ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে চাই।”
ইমাম খোমেনীকে গ্রেফতার করে সরাসরি এয়ারপোর্টে নেয়া হয়।

এর প্রায় সাতমাস পর আমেরিকার সাথে এক চুক্তি করলো শাহ। এই চুক্তি অনুযায়ী যত বড় অপরাধীই হোক, যদি সে আমেরিকান হয় তবে ইরানের মাটিতে তাকে কোনো ধরণের শাস্তি প্রদান করা হবে না। ইমাম খোমেনী এর তীব্র বিরোধিতা করে ধর্মীয় এক সভায় বক্তব্য দেন। সেদিন রাতেই আবার গ্রেফতার হলেন তিনি। গভীর রাতে উঁচু উঁচু দেয়ালে দড়ি লাগিয়ে কমান্ডো স্টাইলে তাঁর বাড়িতে ঢুকে পড়লো শাহের বাহিনী। এরপর দরজা ভেঙে ঢুকলো ইমামের ঘরে। ইমাম বলললেন : যদি তোমরা রুহুল্লাহর খোঁজে এসে থাকো, তবে এইযে আমি রুহুল্লাহ।” এই কথা বলে তিনি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে গ্রেফতারের ব্যাপারে নিষেধ করলেন শাহের বাহিনীকে। এরপর তারা ইমামকে নিয়ে গেলো। এবার আর তাঁকে জেলে রাখা হলো না। গাড়িতে করে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হলো তেহরান এয়ারপোর্টে। সেখানে তিনি জানতে পারেন যে তাঁকে তুরস্কে নির্বাসনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে শাহ। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে, তা হলো, দেশব্যাপী ইমামের জনপ্রিয়তার কারণে ইমামের ডাকে বিভিন্ন সময়ের বিক্ষোভ মিছিল, শোকদিবস পালন ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মসূচীতে জনতার যে ঢল নেমেছিলো, তা থেকেই বোঝা গিয়েছিলো ইমামকে হত্যা করলে শাহের মসনদ-ই ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই গুপ্তহত্যার ইচ্ছা সত্ত্বেও নিজ স্বৈরাচারী ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ইমামকে নির্বাসনে পাঠালো মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভী।

ইমামের গঠন করে যাওয়া বিপ্লবী কমিটির দ্বীনি ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিলেন, ইমামের বহিষ্কারাদেশে সাক্ষর করা প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করার। সেমতে প্রধানমন্ত্রী গাড়ি থেকে নামার সময় চিঠি দেবার নাম করে সামনে এগিয়ে গেলেন এক বিপ্লবী। সাথে লুকানো ছিলো পিস্তল। তার সাথে যোগ দিলেন রাস্তার অপর পাশের কয়েকজন বিপ্লবী। দুনিয়া থেকে বিদায় দেয়া হলো শাহের অত্যাচারের এক হাতিয়ারকে। তারপর সেই বিপ্লবীকে যখন গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করা হলো, সেখানে এক বিস্ময়কর কনভার্সেশান হয়। সেই বিপ্লবী সরাসরি বললেন : “আমি আমার ধর্মীয় ইমামের বহিষ্কারের প্রতিশোধ নিয়েছি।”
তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো : “তুমি কি মুসলিম ?”
হ্যাঁ।
তুমি কি ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান ?
হ্যাঁ।
তুমি কি জানো মানুষকে হত্যা করার জন্য অনুমোদন লাগে ?
হ্যাঁ।
কে তোমাকে সেই অনুমোদন দিলো ?
উত্তরে সেই বিপ্লবী বললেন : "ইমাম খোমেনী।"
প্রশ্ন করা হলো : কখন ?
বিপ্লবীর উত্তর : “যখন তিনি (ইমাম) বললেন যে আল্লাহ জানেন যে তারা বিশ্বাঘাতকতা করেছে, আর এর শাস্তি হলো বুলেট।”

শুরু হলো নির্বাসনে ইমামের জীবন। যার ১৪ বছর পর দেশে ফিরতে সক্ষম হন তিনি। ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও ঘটনাবহুল ছিলো এই ১৪ বছর, যার মাঝে অল্প কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করবো, যা না করলেই নয়।

নির্বাসনে ইমাম
তুরস্কে ইমাম ও তাঁর ছেলে আহমদ (পিছনে)। পাগড়ি খুলে নেয়া হয়েছে।

১৯৬৪ সালে ৬২ বছর বয়স্ক ইমামকে তুরস্কে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সেক্যুলার টার্কিশ গভর্নমেন্ট প্রথমেই ইমামের পাগড়ি পরার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষিদ্ধ করা হয় ধর্মীয় পোষাক পরাকেও। বড় ছেলে মুস্তাফাকে চিঠি লেখেন ইমাম, যার গুরুত্ব বিবেচনা করে এখানে তুলে ধরছি :
প্রিয় সাইয়্যেদ মুস্তাফা ! আল্লাহ তোমার সাহায্যকারী হোন এবং তাঁর সন্তুষ্টির দিকে তোমাকে পরিচালিত করুন – আলহামদুলিল্লাহ ! আমি নিরাপদে আঙ্কারায় পৌঁছেছি গত সোমবার। আলহামদুলিল্লাহ ! আমার স্বাস্থ্য ভালো আছে, চিন্তার কিছু নেই। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য কোনো অনিষ্টকে পূর্বনির্ধারিত করে দেন না। এইখান থেকে আমি আমার পরিবারের সকল সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজনকে শুধু আল্লাহর দ্বারস্থ হতেই উপদেশ দিচ্ছি, এবং তারা যেনো আর কারো সাহায্যপ্রার্থী যেন না হয়। আর আমি তোমাকে ধৈর্য ধরার ও দৃঢ় থাকবার উপদেশ দিচ্ছি। আল্লাহর ইচ্ছা অবশ্যই পূর্ণ হবে।”
এদিকে টার্কিশ সরকার একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজছিলো, যেখানে ইমাম তাঁর বাকী জীবন কাটাতে পারবেন। কিন্তু ইমাম টার্কিশ ভাষা শেখার সিদ্ধান্ত নিলেন। তুরস্কের ভাষা শিখলে সাধারণ মানুষের সাথে ইমামের যোগাযোগ সম্ভব হবে, এই আশঙ্কায় গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা তাঁকে আরেক শহরে নিয়ে গেলেন এবং সেখানে সার্বক্ষণিক নজরদারীতে রাখলেন, যেনো ইমাম খোমেনী টার্কিশ ভাষা শিখতে না পারেন।

নির্বাসনে থেকেই ইমাম বিভিন্ন ধর্মীয়-রাজনৈতিক ইস্যুতে দেশের জনগণকে বার্তা পাঠাতেন, ফতোয়া জারি করতেন। ইসলামবিদ্বেষী এই সরকারের সাথে যেকোনোরূপ সহযোগীতা করা, সরকারের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা, সরকারের কর্মকাণ্ড প্রচার করাকে হারাম ঘোষণা করলেন তিনি।

ইমামের উপর নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল হলে তিনি মসজিদে যেতে শুরু করলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তুর্কী ভাষায় মসজিদে এক ভাষণ দিলেন ইমাম, যার ফলশ্রুতিতে ভীত টার্কিশ সরকার তাঁকে দেশে রাখতে অস্বীকৃতি জানালো। ৫ই অক্টোবর ১৯৯৫ সালে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ইমাম খোমেনী প্লেনে উঠলেন।
সাদ্দাম-পূর্ব ইরাক সরকার বৈরী ছিলো না।

ইরাকের বাগদাদ এয়ারপোর্ট পৌঁছালেন ইমাম খোমেনী। শুরু হলো ইরাকে দীর্ঘ নির্বাসন জীবন।
ইমাম খোমেনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে নাজাফ ও কারবালাসহ ইরানের বিভিন্ন স্থান থেকে দ্বীনি ছাত্ররা তাঁর সাথে দেখা করতে এলেন। কিছুদিন পর কারবালায় পৌঁছালে সেখানের আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ আল শিরাজির অতিথি হিসেবে কিছুদিন থাকেন এবং সেখানেও নামাজের নেতৃত্ব দেন। এরপর ইমাম নাজাফে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। নির্বাসন জীবনের ১৩ বছর ইমাম এখানেই ছিলেন। আর নাজাফ ছিলো ইসলাম ধর্মচর্চার এক বিখ্যাত কেন্দ্র। সেখানেও ইমাম শিক্ষকতাসহ আলেমগণের মাঝে তাঁর বৈপ্লবিক চেতনার প্রচার করেন। ইমামের স্ত্রী এবং বড় ছেলেও তাঁর সাথে সেখানে এসে থাকেন। ইরান সরকার ভেবেছিলো যে প্রচলিত ধারার রাজনীতি থেকে দূরে থাকা নাজাফি আলেমগণের মাঝে ইমাম খোমেনীর থাকাটা ইরান সরকারের পক্ষে সুবিধাজনক হবে। কিন্তু ইমাম নিজস্ব হাওজা খুলে বসলেন এক মসজিদে, এবং সেখানে ফিকাহ শিক্ষা দিতে শুরু করেন। বছরখানেকের মাঝেই তাঁর বিপ্লবী চিন্তাধারা, বেলায়েতে ফকীহ, অর্থাৎ ইসলামী সরকার নিয়ে লেকচার দেয়া শুরু করেন। এসব লেকচার থেকেই পরবর্তীতে ইরানের সংবিধানের মূলনীতি তৈরী করা হয়। পলিটিকাল ইসলাম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ইমাম বলেন :
ইসলাম শুধুমাত্র মানুষের সাথে স্রষ্টার সম্পর্কের আলোচনায় সীমিত নয়। ইসলাম একটি পলিটিকাল ধর্ম। ইসলামের পলিটিক্স এর অন্যান্য নিয়ম-নীতি ও ইবাদতের সাথে জড়িত। যেহেতু সরকারের একটি পলিটিকাল দিক আছে, ইসলামেরও বিভিন্ন পলিটিকাল দিক আছে।”
নির্বাসনে থেকেও দ্বীনি শিক্ষকতা থেকে থাকেনি।

ইরাকে অতি সতর্কতার সাথে নিজের হাওজা পরিচালনা করেন ইমাম। সেখানের কোনো আলেম কিংবা কারো যেনো এটা মনে না হয় যে তিনি সেখানে কর্তৃত্বশীল হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন, সে জন্যে ইমাম তাঁর শিক্ষকতা ও অন্যান্য বক্তব্যকে সুকৌশলী করেন, এবং মূলতঃ ইরানের সাথে যোগাযোগ রেখে বিপ্লব পরিচালনায় মনোনিবেশ করেন। তা সত্ত্বেও তাঁর চিত্তাকর্ষক বক্তব্যের কারণে এমনকি নাজাফেও ছাত্রের সংখ্যা বাড়তে লাগলো, এবং ইরান, ইরাক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে, এমনকি ইন্ডিয়ানরা পর্যন্ত তাঁর ক্লাসে আসতে শুরু করলেন।
কঠোর নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করতেন ইমাম।

ইমাম খোমেনী তাঁর কঠোর নিয়মতান্ত্রিক জীবনের জন্য নাজাফে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। সত্তরোর্ধ বয়সেও তিনি নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করতেন। চারটায় তাহাজ্জুদ নামাজ ও কোরআন পড়া থেকে শুরু করে ফজর পার করে ছয়টা পর্যন্ত ইবাদতে মশগুল থাকতেন। এরপর আধাঘন্টামতন বিশ্রাম নিয়ে মসজিদে চলে যেতেন, যেখানে তাঁর হাওজা (শিক্ষাদান কেন্দ্র)। সেখানে লেকচার দেয়া শেষে সাড়ে এগারোটায় ঘরে ফিরে খাবার খেতেন ও বিশ্রাম নিতেন। এরপর ছাত্রদের উদ্দেশ্যে দেয়া লেকচারগুলো নিজে লিপিবদ্ধ করতেন। তারপর ভিজিটরদেরকে সময় দিতেন পাঁচ থেকে দশ মিনিট করে। যোহরের নামাজ তিনি মসজিদে আদায় করতেন। একটার দিকে বাসায় ফিরে দুপুরের খাবার খেতেন। এরপর আধাঘন্টা থেকে পৌনে এক ঘন্টা ঘুমাতেন। চারটার দিকে নিজ হাতে বানানো চা খেতেন। সোয়া চারটায় ছাদে কিংবা পিছনের উঠানে আধাঘন্টা হেঁটে পড়াশুনায় বসতেন। সন্ধ্যায় নামাজ শেষে বাড়ির উঠানে ৪৫ মিনিট একাকী বসতেন। রাত একটার দিকে হযরত আলীর কবরে যেতেন, এবং ফিরে এসে দুটো পর্যন্ত স্টাডিতে সময় কাটান। এরপর দু-ঘন্টা ঘুমিয়ে তিনি আবার চারটা থেকে দিন শুরু করতেন। সর্বমোট চার ঘন্টারও কম ঘুমাতেন তিনি। ইরাক থেকে শুরু করে জীবনের শেষ পর্যন্ত এই রুটিন অনুসরণ করেছিলেন ইমাম।

এদিকে ইরান...
ইরানে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্র উদযাপনে গ্র্যান্ড প্যারেড।

ইরানে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্র উদযাপন করতে শাহ ব্যাপক আয়োজন করলো। ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে বহু রাষ্ট্রপ্রধান, রাজাসহ উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলো। গ্র্যান্ড প্যারেড শেষে ভোজসভার আয়োজন করা হলো। সেখানে ৬৯ টা দেশের ৫০০ অতিথির খাবারের আয়োজন করা হয়েছিলো। সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে বিলাসবহুল ভোজসভা ছিলো সেটা। সিল্ক ও মখমলের তৈরী স্বর্ণখচিত ১৭টি তাঁবুতে চলছিলো ভোজ উৎসব। ফ্রান্সের Maxim's রেস্টুরেন্ট থেকে বিমানযোগে আনা হয়েছিলো খাবার। কল্পনাতীত বিলাসিতায় মেতে উঠেছিলো শাহ। আর ওদিকে খোদ তেহরানেই রাস্তার পাশে তাঁবু খাটিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে মানুষ মরছিলো অন্ন-বস্ত্রের অভাবে। সেদিনের ভোজসভায় শাহ ও তার সুন্দরী স্ত্রী ফারাহ দিবার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা যে আর মাত্র আট বছর পরেই চির মলিন হবে, সেটা কি তারা কল্পনা করতে পেরেছিলো ?
রাজকীয় তাঁবুতে ভোজসভা।

শাহ তার স্বৈরশাসন চালিয়ে যেতে লাগলো। ওদিকে ইরাকের নাজাফে বসে ইমাম খোমেনী শাহের সাথে লড়াই করতে থাকেন। আর এই লড়াই অস্ত্রের মাধ্যমে ছিলো না। এই লড়াই ছিলো জনগণকে সচেতন করার লড়াই। মুসলমানদের সচেতন করতে করতে এমন পর্যায়ে উন্নীত করা, যেনো শাহের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও ধোঁকাবাজিতে প্রতারিত হবার মত একটি মানুষও না থাকে। আর সেই পর্যায়ে পৌঁছালে শাহের উৎখাত ও ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়ে পড়ে স্বতঃস্ফূর্ত একটি প্রক্রিয়া। যাহোক, নাজাফ থেকে ইমাম খোমেনী শাহের এই ব্যাপক বিলাসী ভোজসভার তীব্র নিন্দা করে বক্তব্য পাঠালেন।

ইমামের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বিপ্লব চলতে লাগলো একাধারে ইমামের নির্দেশনা ও কোমে তাঁর ছাত্রদের উদ্যোগে। আয়াতুল্লাহ বেহেশতী, আয়াতুল্লাহ মুতাহারি, আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী, হাশেমী রাফসানজানিসহ আরো অনেক আলেম বিভিন্ন শহর ও গ্রামে যেতেন, মানুষকে সচেতন করতেন সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে, এবং জানাতেন শাহ কর্তৃক ইমাম খোমেনীকে বহিষ্কারের ঘটনা। গোটা ইরানে ইমাম খোমেনী তখন ইরানের অবিসংবাদিত মুসলিম নেতা।

ইরাকের সাথে ইরানের বর্ডার থাকায় সহজেই ইমামের লিখিত বক্তব্য গোপনে ইরানে পাঠানো সম্ভবপর হয়। গোপনে প্রিন্ট করা এসব বক্তব্য অতি সতর্কতায় বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে ইরানে পাঠানো হতো। এছাড়াও তিনি টেপ রেকর্ডারে বক্তব্য রেকর্ড করে ক্যাসেট পাঠিয়ে দিতেন। সেখান থেকে তাঁর বক্তব্য লিখে প্রচার করা হতে থাকে। এর জন্য বিশেষায়িত টিম ছিলো। ইমামের বক্তব্য পাওয়ার সাথে সাথে তারা সেগুলোর অসংখ্য কপি করে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতেন।
ইমাম তাঁর নিজের ছেলে সাইয়্যেদ আহমাদ এর কাছে চিঠি লিখতেন, এবং সাইয়্যেদ আহমাদও তার উত্তর পাঠাতেন। তবে এগুলো কোডেড (coded) চিঠি ছিলো। অর্থাৎ চিঠির বক্তব্য ইমাম খোমেনী ও তাঁর ছেলে ছাড়া আর কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিলো না। শাহের হাতে পড়ে চিঠি গুম হবার ভয়ে সরাসরি ইরান-ইরাক কিংবা নাজাফ-তেহরান চিঠি না পাঠিয়ে প্রয়োজনে তাঁরা কুয়েত, লেবানন, সিরিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ হয়ে চিঠি নিয়ে যেতেন, কখনোবা ডাকযোগে এইসব দেশ হয়ে ইমামের কাছে পাঠাতেন। ইমামও সেই চ্যানেলেই জবাব পাঠাতেন। এভাবে নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ইমাম খোমেনী ইরানের গণ মুসলমানের জন্য কাজ করে যেতে থাকেন সুদূর নাজাফ থেকে।

সেসময়ে ইরাকের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আব্দুল সালাম আরেফ। ইমাম নাজাফ থেকে ইরানে এত বেশি চিঠি ও অডিও টেপ পাঠাতেন যে, আব্দুল সালাম আরেফ ঘোষণা দিলেন ইমামের জন্য প্রাইভেট রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠা করে দেবার। কৌশলগত কারণে ইমাম তা গ্রহণ করেন এই শর্তে যে, রেডিওর কার্যক্রমে ইরাক সরকার কোনো বাধা দেবে না কিংবা কোনো শর্তারোপ করতে পারবে না। কিন্তু ১৯৬৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাদ্দাম হোসেনের বাথ পার্ট ক্ষমতাসীন হবার পর এ স্বৈরশাসকের সাথে ইমামের কোনো সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হবার সুযোগ থাকলো না।
নির্বাসনে ইরাকের নাজাফে ইমাম খোমেনী, স্থানীয় আলেমগণের সাথে।

এরও বেশ কয়েক বছর পর সাদ্দাম হোসেনের সরকার ইমামের সাথে কথা বলার জন্য আলোচক পাঠালো। যেহেতু ইরান সরকারের সবচেয়ে বড় বিরোধী হলেন ইমাম খোমেনী, এবং যেহেতু তাঁর ব্যাপক জনসমর্থন আছে, তাই ইমামের এই অবস্থানটাকে কাজে লাগিয়ে তারা ইরান সরকারের বিরুদ্ধে ইরাককে সহায়তা করার আহবান জানালো। ইমাম স্পষ্টভাষায় তাদেরকে না করে দিলেন। উপরন্তু বললেন যে, সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে বন্দী করে তারা খারাপ কাজ করেছে।
এমতাবস্থায় ইরাক সরকারের সাথে ইমামের আর সহাবস্থান সম্ভব হলো না। ইমাম ইরাক ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। একথা জানতে পেরে তাঁকে গৃহবন্দী করা হলো। রাজনীতির খেলা এমনই যে, এসময়ে আলজেরিয়ার মধ্যস্থতায় দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ইরান-ইরাক বৈরী সম্পর্ক দূর হলে উভয়পক্ষই দুই দেশে তাদের বিরোধী মতকে দমন করতে সম্মত হলো। ইরাকি ইন্টেলিজেন্স ইমামের সাথে সাক্ষাৎ করে বললো : “আপনি আপনার বক্তব্য লিখে, মুখে বলে কিংবা অডিও ক্যাসেটের মাধ্যমে ইরানে পাঠাতে পারবেন না, কারণ এটা আমাদের (ইরান-ইরাক) দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বাইরে।” ইমাম উত্তরে বললেন:
এটা আমার ধর্মীয় দায়িত্ব যে আমি ডকুমেন্টস তৈরী করবো এবং প্রয়োজনসাপেক্ষে বক্তব্য দেবো। অডিও টেপ রেকর্ড করবো এবং ইরানে পাঠাবো। এটা আমার ধর্মীয় দায়িত্ব।...”

ইমামের বড় ছেলের শাহাদাত

সেপ্টেম্বর ১৯৭৮। ইমাম খোমেনীর বড় ছেলে সাইয়্যেদ মুস্তাফার সাথে কয়েকজন দেখা করে রাত আড়াইটার দিকে ফিরে গেলো। সকালে সাইয়্যের মুস্তাফার বন্ধুরা এসে তাঁকে ডাকলেন। জবাব না পেয়ে তাদের একজন উনার কাঁধে নাড়া দিলেন। সাইয়্যেদ মুস্তাফা পড়ে গেলেন : মৃত। মাঝরাত থেকে ভোরের মাঝে তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো। হসপিটালে নেবার পর ডাক্তার বললেন বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে।
ইমাম খোমেনী এর কিছুই জানতেন না। ইমামের ছোট ছেলে সাইয়্যেদ আহমাদ বাড়ি ফিরে উপরতলায় দরজা আটকে কান্না করছিলেন। আর অন্যান্যেরা যখন ইমামের সামনে বসলেন, তীব্র কষ্ট ও বেদনায় তারা মুখ দিয়ে কিছুই বলতে পারলেন না। ইমাম বুঝতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলেন, আহমাদ কোথায় ? এরপর তিনি দ্বিতীয়বার তাঁর ছোট ছেলের নাম ধরে ডাকেন। এরপর সবাইকে উদ্দেশ্যে করে বললেন : “আমি বুঝতে পারছি কী ঘটে থাকবে। তাই আমাকে বলো, মুস্তাফার কিছু হয়েছে ?”
তখন উপস্থিত সবাই মাথা নিচু করলেন। ইমাম খোমেনী সবসময় মেঝেতে বসে বৈঠক করতেন। ইমাম তাঁর আঙুল মেঝেতে স্পর্শ করে কিছুক্ষণ হাতের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। এরপর বললেন মৃতদেহকে ২৪ ঘন্টা পরে দাফন করতে। উপস্থিত যাঁরা ইমামের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁরা পরে বলেছিলেন যে ইমাম যখন মেঝেতে আঙুল স্পর্শ করে সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন, তিনি যেনো তাঁর হৃদয় থেকে ছেলের প্রতি সমস্ত ভালোবাসা শূন্য করে দিচ্ছিলেন, আর সেটাকে আল্লাহর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি দিয়ে প্রতিস্থাপন করছিলেন। এরপর তিনি খুব শান্ত হয়ে গেলেন।
ইমাম খোমেনী তাঁর বড় ছেলের মৃত্যুতে কান্না করেননি। এমনকি দাফনের সময়ও তাঁকে কাঁদতে দেখা যায়নি। কিন্তু যখন ইমাম হুসাইন (.) এর শাহাদাতের ঘটনার বর্ণনা করা হয়, তখন ছাড়া। এমনকি যেদিন তাঁর বড় ছেলের মৃত্যু হলো, মসজিদের সবাই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলো, যখন ইমাম জামাতে নামাজ আদায় করলেন, অথচ তখনও তাঁর ছেলের দাফন হয়নি। এরপর তিনি নিয়মমতো মিম্বরে বসে লেকচার-ও দিলেন।

এসব ঘটনা প্রতিটা মানুষের জীবনেই আসে। কিন্তু আল্লাহর সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্কের উচ্চতায় পৌঁছালে মানুষের জীবন দর্শন বদলে যায়, এবং আপাতঃ দুঃখ-কষ্টকে তখন মহান আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ হিসেবে উপলব্ধি হয়। এজন্যেই ইতিহাসে ইমাম খোমেনীর মত মানুষকে দেখা যায ছেলের শাহাদাতেও দৃঢ় থাকতে, বড় বড় আলেম-ওলামাকে দেখা যায় জালিমের ফাঁসিকাষ্ঠে প্রশান্তচিত্তে স্মিতহাস্যে দাঁড়িয়ে থাকতে। কারণ এটাকে তারা এক দুনিয়া থেকে আরেক দুনিয়ায় গমন মনে করেন মাত্র, আর সেই দুনিয়া হলো আল্লাহর একনিষ্ঠ খাদেমের পরম পাওয়া।

ফ্রান্সে গমন : বিজয় অত্যাসন্ন

মধ্যপ্রাচ্যের কোনো মুসলিম দেশ-ই ইমাম খোমেনীকে গ্রহণ করতে রাজি হলো না। বাধ্য হয়ে তিনি ফ্রান্সের টিকিট কাটলেন এই ভেবে যে, সেখানে কিছুদিন থাকার পর কোনো মুসলিম দেশে গিয়ে হয়তো থাকতে পারবেন। অথচ তাঁর ফ্রান্সে অবস্থান-ই হয়ে উঠলো বিপ্লবকে সফল করার এক শক্তিশালী হাতিয়ার। ইমাম খোমেনী প্লেনে ওঠার ঠিক আগ দিয়ে ইরাকের বাথ পার্টির সরকার ইমামের ইরাকে ফেরার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে একটা ডিক্রি জারি করলো। এই ভয়ে যে, ফ্রান্স সরকার যদি আবার ইমামকে ফেরত পাঠায়, তবে ইমামকে নিয়ে তারা আবার ঝামেলায় পড়ে যাবে।

-ই অক্টোবর, ১৯৭৮ সালে ইমামকে বহনকারী প্লেন প্রথমে কুয়েত পৌঁছালে কুয়েত সরকার তাঁকে এক মিনিটও থাকতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ইমাম কিছুদিন নো ম্যানস ল্যান্ড - এ এমন অবস্থায় থাকেন, যখন কোনো সরকারই তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। এরপর ইরাক সরকার আবার তাঁকে প্রবেশ করতে দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর ইমাম ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে তাঁর ইরাকে ফেরা নিষেধ করে ডিক্রি জারি করে। আর এর কয়েক মাস পরই ইমাম খোমেনী বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরেছিলেন। নিয়োগ দিয়েছিলেন সরকার, ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী সর্বজন মান্য অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু এর জন্য নিজে কোনো ক্রেডিট নেয়া তো দূরের কথা, বরং ইমাম বলেছিলেন :
আমাদের প্যারিসে যাবার কোনো প্ল্যানই ছিলো না। আমাদের কোনো ইচ্ছা কিংবা হস্তক্ষেপ ছিলো না যা যা ঘটেছিলো তার উপর। অতীতে যা ঘটেছে এবং এখন যা ঘটছে, তার সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আমি নিজস্ব কোনো ভূমিকা দেখি না এতে, কিংবা যা যা ঘটেছিলো তার উপর কোনো দাবীও করি না, কিংবা আপনারাও না, কারণ যত যা ঘটেছিলো, তার সবই ছিলো আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন। কারণ এমন সব ঘটনা ঘটতো, যা আমরা চাইনি, কিন্তু শেষমেষ তা আমাদের পক্ষে সাহায্যই করেছিলো।”
প্যারিসের রাস্তায় ইমাম খোমেনী।

যাহোক, ফ্রেঞ্চ সরকার তাঁকে ওয়েলকাম করলো এই বলে যে, ইমাম খোমেনী শাহ বিরোধী কোনো কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু ইমাম তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, আমি ফ্রান্সকে কোনো বক্তব্য বা ইন্টারভিউ দেবো না, বরং আমি ইরানে বক্তব্য পাঠাবো। এবং আমি বিপ্লব ও ইরানী জনগণের জাগরণের নেতৃত্ব দেবো।”

যেহেতু ইমাম কোন ইন্টারভিউ দেবেন না বলেছিলেন, সুতরাং সাংবাদিকেরা বাড়ির বাহির থেকে তাঁর ছবি তুলে এই বলে প্রকাশ করলো যে, ইমাম খোমেনীকে বন্দী করে রাখা হয়েছে এবং তাঁকে কোনো পলিটিকাল বক্তব্য দিতে দেয়া হচ্ছে না। এর ফলে মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবীদার ফরাসি সরকার চাপের মুখে পড়লো। ইরানী জনগণ, বিশেষতঃ তেহরানের মানুষেরাও ফরাসি সরকারের মত পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছিলো। অসংখ্য মানুষের মিছিল ফরাসি দূতাবাসের সামনে ফুল নিয়ে গেলো ইমামকে আশ্রয় দেবার জন্য কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হিসেবে। ফরাসি সরকার দেখলো যে ইরানি জনগণের মাঝে তাদের জনপ্রিয়তা আছে, সুতরাং ইমামের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হলো। শুরু হলো ইমামের নওফেল--শাতুর সেই বাড়িতে সংবাদকর্মীদের মিছিল। বাড়িটা হয়ে উঠলো বিপ্লবের সাময়িক হেডকোয়ার্টার। সেইসাথে প্রবাসী ইরানীরাও এসে তাঁকে সমর্থন জানাতে শুরু করলো। ফ্রান্সে ইমামের অবস্থানের কয়েক মাসে গড়ে প্রতিদিন ৪-৫ টি করে ইন্টারভিউ দিতেন তিনি। এসময়েই ইরান পরিচিত হয়ে উঠলো বিশ্ববাসীর কাছে। এবং সারা দুনিয়ার সচেতন ব্যক্তিরা ভাবতে শুরু করলো : কী ধরণের মানুষ এই ইমাম খোমেনী ?
সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন ইমাম খোমেনী।

পরবর্তীতে ইমামের সাথে সাক্ষাৎ করা সাংবাদিকদের অনেকে অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। অনেকের মূখেই যা শোনা গিয়েছে, তা অনেকটা এমন যে, ইমাম খোমেনীর সাথে এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ বিরাজ করতো। তিনি রুমে ঢোকামাত্র প্রশান্ত, পবিত্র এবং নীরব এক পরিবেশের সৃষ্টি হতো। ইমাম খোমেনী স্বল্পভাষী ছিলেন। তিনি কথা বলতেন ধীরে, এবং মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। সামগ্রিকভাবে তাঁকে দেখলে কেবল ভালোবাসতে এবং সম্মান করতেই ইচ্ছা করবে। বিপ্লবের পরপর আহমদ দীদাত ইমামের সাথে সাক্ষাৎ করে সাউথ আফ্রিকায় ফিরে শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এভাবে :
আমরা ইমামের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল মুসাভি আল খোমেইনী। আমরা প্রায় চল্লিশজনের মত ছিলাম। আমরা ইমামের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ইমাম এলেন, তার থেকে দশ মিটার মত দূরে ছিলাম আমি; আমি ইমামকে দেখলাম। তিনি আমাদেরকে প্রায় আধাঘন্টার একটি লেকচার দিলেন, আর কুরআনের বাইরে এতে কিছু ছিলো না। এই মানুষটা যেনো কম্পিউটারাইজড এক কুরআন। আর তিনি যখন পাশের একটা রুম থেকে হেঁটে এসে ভিতরে ঢুকলেন, সবার উপর তাঁর যে প্রভাব (আহমদ দীদাত এখানে “electric effect” কথাটি ব্যবহার করেছেন – অনুবাদক।), তাঁর যে কারিশমা – বিস্ময়কর ! তাঁর দিকে তাকানোর সাথে সাথে কোনো ভাবনা ছাড়াই চোখের কোল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আপনি তাঁর দিকে তাকান : আপনার চোখ অশ্রুসজল হয়ে যাবে। এর চেয়ে বেশি হ্যান্ডসাম মানুষ আমি জীবনে কখনো দেখি নাই। কোনো ছবি, ভিডিও বা টিভি তাঁকে উপযুক্তভাবে তুলে ধরতে পারবে না : আমার সারা জীবনে দেখা সবচে' হ্যান্ডসাম মানুষ হলেন তিনি। (“No picture, no video, no TV could do justice to this man, the handsomest old man I ever saw in my life was this man, Imam Khomeini.” – Ahmed Deedat)”

শুরু হলো চূড়ান্ত আন্দোলন

ইমাম খোমেনীকে ১৯৬৪ সালে নির্বাসনে পাঠানোর পর শাহ মোটামুটি স্বস্তিতে ছিলো এই কারণে যে, ইমামের অনুপস্থিতিতে একদিকে যেমন সরকার উৎখাতের আশঙ্কা ছিলো না, অপরদিকে তেমনি বিপ্লবীদের উপর সর্বাত্মক নজরদারী ও জেল-জুলুমের ফলে সরকারের প্রতি হুমকিও স্তিমিত হয়ে এসেছিলো। কিন্তু ইমামের ফ্রান্স গমনের পর সবকিছু যেনো আকস্মিকই বদলে গেলো। ইমাম খোমেনী পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণে বক্তব্য পাঠাতে লাগলেন ইরানে। আর গোটা বিশ্বও জেনে গেলো : একটি বিপ্লব অত্যাসন্ন।
শেষের দিকে ইমামের নাম উচ্চারণ করাও নিষিদ্ধ ছিলো। কোনো জনসভায় ইমামের নাম উচ্চারিত হতে পারতো না বর্বর সাভাক বাহিনীর ভয়ে। আর এই সাভাক বাহিনী তাদের নিষ্ঠুরতার প্রশিক্ষণ পেয়েছিলো মার্কিন ও ইহুদি গোয়েন্দা সংস্থার হাতে, আগেই বলেছি। প্রসঙ্গত, আমাদের দেশেও বর্তমানে বিদেশী বাহিনীর হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনী অনুরূপ জুলুম-নির্যাতনেই নিয়োজিত। যাহোক, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সেপ্টেম্বরে (১৯৭৮ সালে) ইমাম খোমেনীর বড় ছেলেকে বিষ প্রয়োগে হত্যার ঘটনা ইরানে আবারও ইমাম খোমেনীর নাম ধ্বনিত করলো। সাধারণ মানুষ ইমামের ছেলের শাহাদাতে শোকসভা করতে শুরু করলো। বর্বর সাভাক বাহিনীকে উপেক্ষা করে চারিদিকে উচ্চারিত হতে থাকলো বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনীর নাম। শাহ বিষয়টাকে ছাড় দিতে পারতো : এমনিতেই কিছুদিন পর মানুষের শোক স্তিমিত হয়ে আসতো। কিন্তু শাহ উল্টা পথ বেছে নিলো : স্বৈরশাসকের চিরাচরিত নিপীড়নমূলক পথ। সিভিল গভর্নমেন্ট বাতিল করে সেনা শাসন নিয়ে এলো মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভী। নিরস্ত্র শোকাচ্ছন্ন জনতার বিপরীতে রাস্তায় নেমে পড়লো সশস্ত্র সেনা, ট্যাংক, অস্ত্র, গোলাবারুদ।

এযাবৎকাল পর্যন্ত ইরানে যত রাজা-ই শাসন করেছে, তারা ধর্মীয় নেতাগণকে সম্মান করতো। এর মূল কারণ ছিলো জনগণের মাঝে ধর্মীয় নেতাগণের শক্তিশালী প্রভাব। তবে যেহেতু ধর্মীয় নেতাগণ রাষ্ট্র ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ ও সরকার উৎখাতের কোনো চেষ্টা করতেন না, বরং শরিয়ত শিক্ষাদানের মাঝেই নিজেদের কার্যক্রমকে সীমাবদ্ধ রাখতেন, সেহেতু কোনো বড় ধরণের কনফ্লিক্টের সৃষ্টি হতো না। রেজা পাহলভী প্রথম চেষ্টা করে তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের অনুকরণে ইরানে সেক্যুলারিজম আমদানী করতে। অথচ ইসলামী চেতনায় দৃঢ় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় সেক্যুলারিজম কখনোই টিকবে না, ইন ফ্যাক্ট, সেক্যুলারিজম জিনিসটাই একটি দুর্বল ব্যবস্থা যা ভেঙে পড়তে বাধ্য – এই ঐতিহাসিক এবং দার্শনিক সত্যটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলো সে। ফলস্বরুপ আলেমগণের উপর নির্যাতন শুরু করলো, এবং আঘাত হানলো ইসলামের উপর, আর যা চালিয়ে গিয়েছিলো তার ছেলে মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভী। ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে। স্বৈরশাসকেরা সবসময়ই ভুল করে থাকে, আর সত্য স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং শোকাচ্ছন্ন জনগণের উপর শাহের জালিম বাহিনীর নির্যাতন শোককে শক্তিতে পরিণত করলো। শুরু হলো রাজপথে সরাসরি আন্দোলন। পর্যায়ক্রমে সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে এলো। আর বর্বর বাহিনীও চালিয়ে যেতে লাগলো প্রকাশ্য গণহত্যা। এলো সেই বিপ্লবী ডাক :
বিপ্লবী জনসমুদ্র।

জেগে উঠুন হে জনগণ ! সাবধান হোন, কারণ আপনাদের শত্রু শক্তিশালী। সে ট্যাংক ও মেশিনগান নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু এসব অস্ত্রকে ভয় পাবেন না। আপনারাই সঠিক পথে আছেন। হক আপনাদের সাথে আছে। আর সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা আপনাদের সাথে আছেন। ভয় পাবেন না, কারণ আপনারাই বিজয়ী হবেন ইন-শা-আল্লাহ।”

টর্চারিং সেলে নিয়ে সাধারণ মানুষ, বিশেষতঃ ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টদের উপর নিষ্ঠুরতম নির্যাতন চালানো হলো, যার চিহ্ন এখনও অনেকে বয়ে বেড়াচ্ছেন। লোহার বিছানায় তরুণ ছেলেদের বেঁধে রেখে নিচে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করাসহ বর্ণনার অযোগ্য সব নির্যাতন চালিয়েছিলো শাহের জাহান্নামী বাহিনী। ইরানের বেহেশতে যাহরা কবরস্থানে বিপ্লবের এই হাজার হাজার শহীদ ঘুমিয়ে আছেন।

এর ঠিক এক বছর আগেই ডিসেম্বর ১৯৭৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ইরানে গিয়ে বলেছিলো : “ইরান তার চমৎকার নেতৃত্বের মাধ্যমে এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে...।” ইরান থেকে সিআইএ যে রিপোর্ট পাঠাতো, তাতে ইরানের ব্যাপারে মোটামুটি সন্তুষ্ট ছিলো আমেরিকা। আর সিআইএ ইরানি সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে যখন তথ্য সংগ্রহ করতো, তারা বলতো যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণেই আছে। তাছাড়া সেসময়ে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি নিয়ে ব্যস্ত ছিলো আমেরিকা। সুতরাং... ইরানের বিপ্লব ছিলো তাদের উপর এক বিরাট আঘাত। আরো একটি বড় কারণ ছিলো, সিআইএ আর সমস্ত পরিবেশে অনুপ্রবেশ করতে পারলেও, ইসলামী পরিবেশকে তারা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি। তাদের ধারণা অনেকটা এরকম ছিলো যে : “এসব মোল্লা মৌলভি, এদের দৌড় মসজিদ পর্যন্ত, এরা আর কদ্দুর কী করতে পারবে। আর যদি কিছু করেও, আমরা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আর আমাাদের অস্ত্রশস্ত্র ও ইন্টেলিজেন্সকে ব্যবহার করে এদেরকে উৎখাত করতে পাবরো সহজেই।” কিন্তু এ ছিলো এক চরম ভুল। প্রকৃতপক্ষে, নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল অত্যন্ত দুর্বল।
বেহেশতে যাহরা কবরস্থান।

ইমাম খোমেনীর এক ছাত্রের ইমামতিতে ইদুল ফিতরের নামাজ শেষে লাখো মানুষ তাদের দাবী নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লো। তেহরানের কসাই বলে পরিচিত এক জেনারেল আদেশ দিলো যেকোনো মিছিল দেখামাত্রই গুলি করতে। পাশ্চাত্য মিডিয়াই সেদিনের মৃতের সংখ্যা ৪০ হাজার বলে প্রকাশ করে, প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরো অনেক বেশি। আর্মির গুলির মুখে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষ শহীদ হয়ে গেলেন। এই হাজার হাজার শহীদ চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বেহেশতে যাহরা কবরস্থানে।

৭ লক্ষাধিক সদস্যের ইরানি আর্মি ছিলো তৎকালীন বিশ্বের পঞ্চম শক্তিশালী আর্মি। এত বৃহৎ শক্তিশালী বাহিনীর সামনে মানুষ কী করবে ? ইমামের স্ট্র্যাটেজি ছিলো অত্যন্ত প্রাজ্ঞ। ইমাম বাণী পাঠালেন :
আর্মির বুকে আঘাত কোরো না, বরং তাদের হৃদয়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করো। সৈন্যদের হৃদয় তোমাদের কামনা করতে হবে। এমনকি তারা তোমাদের গুলি করলেও। তোমাদের বুক পেতে দাও। কারণ যখন তোমরা আল্লাহর রাহে জীবন দিয়ে দিচ্ছো, তখন তোমাদের রক্ত এবং তাদের প্রতি ভালোবাসা তাদেরকে প্রভাবিত করবে। একজন শহীদের রক্ত হলো হাজার মানুষকে জাগিয়ে তোলার ঘন্টা।”
বিক্ষোভকারীরা সৈন্যদের রাইফেলের মুখে গুঁজে দিলো ফুল, আর তাদের স্লোগান ছিলো : "আর্মি আমাদের ভাই, তোমরা কেনো ভাইকে হত্যা করো !” বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী নারীগণ ফুল ছুঁড়ে দিলেন সেনাদের দিকে, আর বললেন : “আমরা তোমাদেরকে ফুল ছুঁড়ে দিলাম, বিনিময়ে তোমরা আমাদেরকে গুলি করে শহীদ করে দাও।” সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ইমামের আহবান ছিলো :
তোমরা শাহের কাজ আঞ্জাম দিও না, কারণ সে শয়তান। আর তোমরা হলে আল্লাহর সৈন্য। তোমাদের মুসলিম ভাইয়ের উদ্দেশ্যে অস্ত্র চালিও না। কারণ একজন মুসলিমের বুকে একটি বুলেট মানে কুরআনের বুকে একটি বুলেট। তোমাদেরকে নিজেদের পরিবারের কাছে ফিরে যেতে হবে, নিজেদের বাড়িতে, শহরে। তোমাদেরকে মসজিদে ফিরে যেতে হবে, ফিরে যেতে হবে আল্লাহর কাছে।”

ইমামের সাথে ছিল আল্লাহর প্রতিশ্রুত সাহায্য। দলে দলে সৈন্য যোগ দিলো বিপ্লবে। ইমামের নেতৃত্ব মেনে নিলো। বিপ্লবী কমিটি থেকে নির্দেশ দিয়ে দেয়া হলো যাদের যা পোশাক আছে নিয়ে আসতে। বিপ্লবে যোগদানকারী সেনারা আর্মির পোষাক ছেড়ে ঐ পোষাক পরলেন। তবুও তাদেরকে আর্মি ছাঁটের চুল দেখে নিপীড়ক বাহিনী শনাক্ত করছিলো। এই দেমে বিপ্লবী কমিটি সব বিপ্লবী যুবককে আর্মি ছাঁটে চুল কাটাতে নির্দেশ দিলো। সৈন্যেরা মিশে গেলো বিপ্লবীদের সাথে। ইমামের আদেশ এলো :
ছোটো ছোটো দলে আর্মি ত্যাগ করো। একা হোক, কিংবা দু'জন তিনজন করে। তোমরা আল্লাহর সৈন্য। তোমাদের অস্ত্র সাথে নাও, সেগুলো আল্লাহর অস্ত্র।”

ইমামের সমর্থনে যখন বেশিরভাগ ব্যারাক খালি হয়ে গেলো, তখন ইমাম খোমেনী বাজারের দিকে মনোনিবেশ করলেন। "বাজার" হলো আমাদের এখানকার মতিঝিল এলাকার মতো, যা কয়েকদিন বন্ধ থাকলে গোটা অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। ইমামের আহবানে সাড়া দিয়ে বাজার স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘটে গেলো, ইরানের অর্থনীতি হয়ে পড়লো স্থবির। এরপর তেলকূপগুলোর কর্মীদেরকে সম্বোধন করলেন ইমাম। নির্দেশ দিলেন দেশের চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদন বন্ধ করে দিতে। শাহ বললো, যদি তেলকূপের কর্মচারীরা ধর্মঘট বন্ধ করে কাজে ফিরে না যায়, তবে তাদের সবাইকে গুলি করা হবে এবং ইসরাঈল থেকে শ্রমিক ও টেকনিশিয়ান এনে তেলকূপ চালানো হবে।
ইরানের তেলকূপে ধর্মঘটের সুযোগে কাজ করতে আসা যেকোনো বিদেশী, হোক সে ইসরাইলী বা অন্য যেকোনো দেশের, তাদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে ফতোয়া জারি করলেন ইমাম খোমেনী। এছাড়াও ধর্মঘটের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদেরকে ধর্মীয় অথরিটির ফান্ড থেকে টাকা দিতে বলা হলো। সাথে সাথে ইমামের ছাত্ররা তেলকূপের কর্মচারীদের মাঝে টাকা বন্টন করে দিলেন, আর এদিকে ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা মার্কিন ও পশ্চিমা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে হামলা চালাতে লাগলো : ব্যাংক, হোটেল, এয়ারলাইনস...। গোটা তেহরান তখন জ্বলছিলো, কিন্তু শাহের কিছুই করার ছিলো না।

শাহের পলায়ন

এরপর ইমাম খোমেনী আশুরা উপলক্ষ্যে মানুষকে রাস্তায় নেমে আসতে নির্দেশ দিলেন। সর্বোচ্চ জনশক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রমাণ করার জন্য যে, এদেশের মানুষ আর শাহকে চায় না। তারা এই রাজতন্ত্র চায় না। সামরিক সরকার সকাল-সন্ধ্যা কারফিউ জারি করলো, এমনকি মসজিদের অভ্যন্তরে পর্যন্ত। ইমাম খোমেনী আদেশ দিলেন বাড়ির ছাদে বিক্ষোভ প্রদর্শনের। সেরাতে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর ছিলো এমন : "সারা তেহরানের বাড়িগুলোর ছাদ থেকে ভেসে আসা আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে তেহরানের মাটি কাঁপছে।"

শাহ ষড়যন্ত্র করলো এক ব্যাপক গণহত্যার। এর মূল টার্গেট ছিলো বিপ্লবের নেতৃস্থানীয় আলেমগণ। আজাদী স্কয়ারে সমবেত বিপ্লবের মূল আয়োজকদের হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হলো। কিন্তু আল্লাহর কী ইচ্ছা – সেই বিকেলেই লাভিযান এর ক্যাম্প থেকে বিপ্লবে যোগ দেয়া এক তরুণ সেনা এসে শাহের ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাকারীদের গুপ্তহত্যা করলো।

এসময়ে শাহ বুঝতে পারলো দেশ তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে, এবং ইরানে তার আর কোনো স্থান নেই। আর্মি সরকার কারফিউ তুলে নিলো, এবং সাথে সাথে তেহরানের রাস্তা পরিণত হলো জনসমুদ্রে। দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এক অস্পষ্ট, বিভ্রান্তিকর ভাষণ দিলো শাহ। মিলিটারি সরকারকে প্রতিস্থাপিত করলো শাপুর বখতিয়ারের নেতৃত্বে নতুন এক সরকার দিয়ে। আর এসব পরিকল্পনা তাকে দেয়া হচ্ছিলো ওয়াশিংন থেকে। জনগণের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির জন্য তারা ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালালো যে, শাপুর বখতিয়ার হলো শাহের দীর্ঘদিনের শত্রু, একজন মানবতাবাদী কর্মী, ইত্যাদি।

দশদিন পর...। তেহরানের মেহরাবাদ এয়ারপোর্ট মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভী ও তার স্ত্রী রানী ফারাহ দিবা পৌঁছে গেলো। প্রেসের কাছে নিতান্ত হাস্যকরভাবে বললো : “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক'দিন বেড়িয়ে আসি।”
১৬ই জানুয়ারী, ১৯৭৯। প্লেনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ইরানের দিকে একবার ফিরে তাকালো এককালের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাহ এবং তার রানী। সারা দুনিয়া তখন সঙ্কুচিত হয়ে আসছিলো তার জন্য। প্লেনের উড্ডয়নের সাথে সাথে ইরানের ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটলো। পরবর্তীতে নানান দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করে ক্যান্সারে ভুগে এযুগের ফেরাউনের শেষশয্যা রচিত হলো মিশরে। এমনকি যেই আমেরিকার গোলামিতে সারাটা জীবন সে ব্যয় করলো, সেই আমেরিকাও তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলো।

শাপুর বখতিয়ার সরকারের মার্কিন প্রভুরা ভাবলো, "এইসব "মোল্লারাই” আপাতত বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিক। এরা তো দুনিয়াবি বিষয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন নয় এবং রাজনৈতিক দূরদর্শীতাও এদের নেই; কিছুদিন পার হলে আমরাই আবার ক্ষমতা লাভ করবো।" কিন্তু আল্লাহ তায়ালার পরিকল্পনা ছিলো ভিন্ন। আর আল্লাহর পরিকল্পনার বিজয়ী হওয়া অনিবার্য। শাপুর বখতিয়ার তার মার্কিন প্রভুদের সাহসে এমনকি ইমাম খোমেনীকে "মাথা খারাপ বুড়ো” পর্যন্ত বলে বসলো। কিন্তু শাপুরের গদিলাভের একমাস যেতে না যেতে সেই "বুড়োই” তাকে সমূলে উৎখাত করে দিলেন। দেশত্যাগের সময় প্রধানমন্ত্রী, সেনা প্রধান ও প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে যে রাজপরিষদ গঠন করে গিয়েছিলো শাহ, সে পরিষদের সভাপতি প্রধান বিচারপতি নিজে প্যারিসে গিয়ে ইমামের আনুগত্য ঘোষণা করেন। ইরানের রাস্তায় রাস্তায় তখন আনন্দ মিছিল আর মানুষের হাতে ইমামের ছবি।

ইমামের দেশে ফেরার প্রস্তুতি

এবার প্যারিস থেকে ইমাম আরেকটি ডাক দিলেন। তা ছিলো শাপুর বখতিয়ারের একমাস বয়সী সরকারকে উৎখাত করা। ১৪ বছরের "ধ্বংস হোক শাহ” শ্লোগান বদলে গেলো "ধ্বংস হোক বখতিয়ার” – এ। আবারও রাস্তায় নেমে এলো জনগণ।

ইমাম আকস্মিকই দেশে ফেরার ঘোষণা দিলেন। সেই সংবাদে বখতিয়ার সরকার এয়াপোর্ট বন্ধ ঘোষণা করলো। অবশিষ্ট যেসব শাহপন্থী সৈন্য ছিলো, তাদের ট্যাংক, অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ঘেরাও করে রাখলো এয়ারপোর্ট। ইমাম ঘোষণা দিলেন যে এয়ারপোর্ট খোলামাত্রই তিনি দেশে ফিরবেন।
মেহরাবাদ এয়ারপোর্ট। চারিদিকে ঘিরে রেখেছে শাহপন্থী সৈন্য ও তাদের ট্যাংক। এবার তাদেরকে ঘিরে ধরলেন ইরানী জনগণ। লক্ষ লক্ষ লোক এয়ারপোর্টের চতুর্দিক ঘেরাও করে ফেললো। ইমাম খোমেনীর নামে শ্লোগান দিতে থাকলো তারা।

ইরান ফিরতে গেলে বিমানে গুলি করে ইমামকে হত্যা করা হতে পারে, এই আশঙ্কায় প্যারিসে ইমামের সঙ্গী সাথী সকলেই এই পরিস্থিতিতে ইরান যাওয়ার বিরোধিতা করলো। কিন্তু ইমাম যেনো আল্লাহর আদেশ পেয়েছিলেন ইরানে ফিরে যাবার জন্য। তাই তিনি বললেন : “তোমাদের বিপদ হতে পারে। আমি আমার সাথে আসার জন্য কাউকে বলবো না।” কিন্তু ইমামের ভক্তরা ইমামকে রক্ষায় নিজেদের জীবন পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত ছিলেন। সুতরাং তারা সকলেই ইরান যাত্রায় ইমামের সঙ্গী হলেন। ১৫০ জন সাংবাদিক ও ৫০ জন উপদেষ্টাকে নিয়ে ইমাম যাত্রা করলেন ইরানের উদ্দেশ্যে। উৎকণ্ঠিত প্লেনের সব যাত্রী। কিন্তু প্রশান্ত ইমাম তাঁর কেবিনে নামাজ আদায় করছেন। এ যেনো নূহ (.) এর সেই নৌকা, আল্লাহর ইচ্ছায়ই যার গতি ও আল্লাহর ইচ্ছায়ই যার স্থিতি।

ইরানের ভূমিতে পদার্পন

এয়ার ফ্রান্স লেখা প্লেনটি যতই অগ্রসর হচ্ছে, ততই লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। অথচ যার জন্যে এত আয়োজন, সেই ইমাম ছিলেন খুবই শান্ত। দেশের মাটিতে নামার পর তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয়, আপনার অনুভূতি কী ? তিনি বলেছিলেন – কিছুই না।
১৪ বছরের নির্বাসন শেষে নিজভূমে ফিরে এলেন ইমাম।

প্লেনের চাকা মাটি স্পর্শ করলো। ইরানের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো – ইসলামী ইরান। ধীরপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন ইমাম খোমেনী। সে এক অন্যরকম দৃশ্য। সাথে তাঁর ছোট ছেলে আহমাদ। ইরানের মাটিতে ইমাম খোমেনীর পদার্পনের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁর ইচ্ছা পূরণ করলেন।
ইমাম এসে দাঁড়ালেন। তাঁর উদ্দেশ্যে সমবেতভাবে গাওয়া হলো বিপ্লবের সেই গান : খোমেইনী এই ইমাম”
ইমাম খোমেনীকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে পর্যন্ত ৭০ লাখ লোকের জনসমুদ্র।

তেরানের মেহরাবাদ এয়ারপোর্ট থেকে একটি গাড়িবহর বেরিয়ে এলো। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে সেদিন রাস্তায় ৭০ লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত হয়েছিলো। ইমাম গাড়ি নিয়ে এগুতে পারলেন না। এমনকি লাঠি দিয়ে পিটিয়েও মানুষকে দূরে সরানো যাচ্ছিলো না। গাড়ির উপরে, পাশে – চারিদিকে মানুষ আর মানুষ। কয়েকবার মানুষ গাড়িকে উঁচু পর্যন্ত করে ফেলেছিলো। গাড়ির ভিতরে কেবল অন্ধকার – মানুষের কারণে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। গাড়ি আর ঠিকভাবে চালানো গেলো না, মানুষই যেনো গাড়িকে ঠেলে নিচ্ছিলো। মানুষের ধাক্কা ও চাপের কারণে পথিমধ্যে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে ইমামকে কোনোমতে একটা হেলিকপ্টারে উঠানো হলো। হেলিকপ্টার সরাসরি চলে গেলো বেহেশতে যাহরা কবরস্থানে, যেখানে ইসলামী ইরানের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতাগণ ঘুমিয়ে আছেন। শহীদদের কবরস্থানে পৌঁছে ইমাম তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা দিলেন। এর আগে একটা গান পরিবেশন করা হয়। "হে আল্লাহর পথের শহীদগণ ! জাগো ! তোমাদের নেতা তোমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন...” এই কথার মর্মস্পর্শী গানটি সমবেতভাবে গায় কিশোরদের একটি দল, আর মঞ্চে ইমামের চারিদিকের বিপ্লবীদের কাঁদতে দেখা যায়। এর মাঝেও ইমাম অত্যন্ত শান্ত থাকেন, এবং তারপর তাঁর বিখ্যাত সেই বক্তৃতা দেন, যেখানে ইসলামী হুকুমত কায়েমের ঘোষণা দেয়া হয়। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই বক্তৃতার শুধুমাত্র সেই বিখ্যাত ঘোষণাটি তুলে ধরছি, যখন ইমাম খোমেনী ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা দিলেন :
ইসলামী হুকুমত কায়েমের ঘোষণা।

আমি সরকার নিয়োগ করবো, আমি এ সরকারের মুখে মুষ্ঠাঘাত করবো, জনগণের সমর্থন নিয়ে এবং জনগণ আমাকে যেভাবে গ্রহণ করেছে সেই শক্তির বলে আমি একটি সরকারকে নিয়োগ প্রদান করবো।”
একটা দেশে দুইটা সরকার থাকতে পারে না। অবৈধ সরকারকে বিদায় নিতে হবে। (হে সরকার !) তোমরা অবৈধ ! আমরা যে সরকারের কথা বলি, তা জনগণের মতামতের উপর নির্ভর করে। সেটা আল্লাহর আইনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তোমাকে হয় আল্লাহ নয়তো জনগণের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত হতে হবে।”
অস্থায়ী হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে ইমাম।

অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার হিসেবে তেহরানের একটি স্কুলে উঠলেন ইমাম খোমেনী। স্কুলপ্রাঙ্গন হাজার হাজার সমর্থকে ভরে উঠলো। কিন্তু তখনও বিপ্লব নিষ্কন্টকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পরবর্তী দশদিন শাহের অতি অনুগত সেনাবাহিনী বিপ্লবী জনতাকে মোকাবিলা করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে লাগলো। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছাই বিজয়ী হওয়ার ছিলো।

আমেরিকা থেকে এক জেনারেল এলো ইরানে, ইমামকে হত্যা ও সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা নিয়ে। ইমামের ছাত্র, হুজ্জাতুল ইসলাম আলী আকবর হাশেমী রাফসানজানি এসে ইমামকে স্কুল ত্যাগ করতে বললেন, কারণ আর্মির পরিকল্পনা ছিলো পুরো বাড়ি বম্বিং করে ধ্বংস করে দেয়ার। কিন্তু ইমাম বললেন :
আমি এখান থেকে নড়বো না। আমি এখানেই থাকবো, কিন্তু তারা এই জায়গায় বম্বিং করতে সক্ষম হবে না। আর যদি করেও, মানুষ তাদেরকে ধরে ফেলবে। যাও, ব্যারাকগুলো দখল করো । কিছুই হবে না।”

রক্তপাত কমানোর জন্য ইমাম অত্যন্ত প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। একদিকে তিনি যেমন বিপ্লবীদের বলেছিলেন সেনাদের হত্যা না করতে, বরং সেনাদের জন্য বুক পেতে দিয়ে তাদেরকে ভালোবাসা দিতে, তাদের হৃদয় জয় করতে, অপরদিকে তেমনি সেনাদেরকে বলেছিলেন মুসলিম ভাইকে হত্যা না করতে। কিন্তু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বেহেশতে যাহরার ভাষণে ইমামের আহবানেও যে সেনারা সাড়া দিলো না, তখন ইমাম তাদের ব্যারাক দখল করে নিতে বললেন। শুরু হয়ে গেলো সশস্ত্র জিহাদ। ছাত্ররা পুলিশ স্টেশন দখল করতে শুরু করলো। এক একটি স্টেশন দখলের সাথে সাথে আরো বেশি অস্ত্র ও যান-বাহন তাদের হাতে চলে আসছিলো। এই নিয়ে এয়ার বেইজে আক্রমণ চালানো হলো। দীর্ঘ যুদ্ধের পর তাদের সিকিউরিটি ভাঙতে সক্ষম হন বিপ্লবীরা।

বেশ কিছুদিন এই যুদ্ধ চললো। অবশেষে বারো দিন পর, ১২ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে হতাশ আর্মি প্রধানরা পালিয়ে যাবার আগে যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা দিয়ে গেলো। দুপুরের পর রেডিও স্টেশন দখল করে নিয়ে বিপ্লবীরা ঘোষণা দিলেন :

এরপর ইসলামী ইরানের গল্প...

সেটা আরেকদিন হবে। তবে শেষ করতে চাই ১৯৮১ সালে ইসলামী ইরানের প্রতিষ্ঠাতা, অবিসংবাদিত নেতা, সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ইমাম খোমেনী কর্তৃক ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রধান বিচারপতির নিকট জমা দেয়া সম্পত্তির বিবরণ দিয়ে। গোটা ইরানি জাতি যাঁর জন্যে জান কোরবান ছিলো, ১৯৮১ সালে সেই ইমাম খোমেনীর সম্পত্তির বিবরণ ছিলো নিম্নরূপ :

নাম : রুহুল্লাহ
বংশগত উপাধি : মোস্তফাভী, খোমেনী নামে পরিচিত।
আইডেনটিটি কার্ড নং : ২৭৪৪
ইস্যুর স্থান : খোমেইন
পেশা : ধর্মীয় নেতা / ধর্মতত্ত্ববিদ (clergyman)

১। স্থানান্তর অযোগ্য / স্থায়ী সম্পত্তি (বিস্তারিতভাবে) : ভিতরে ও বাইরে কিছু জায়গাসহ
. কোমের বাগ--কালেহ তে একটি বাড়ি।
. আমার পিতা থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে একখণ্ড জমি (যৌথভাবে বড়ভাই জনাব মুর্তাজা পসন্দিদাহ, আমি ও আমাদের মরহুম ভাই জনাব হিন্দির সন্তানাদিসহ) পেয়েছি। আমার ভাইয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আমার অংশ থেকে বার্ষিক আয় চার হাজার রিয়াল (৫৪ ডলার)
(i) তেহরানে সামান্য কিছু অর্থ রয়েছে যা আমাকে ব্যক্তিগত উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছিল।
(ii) আমার নিজের কোন আসবাবপত্র নেই। যে কয়েকটি আসবাব কোমে ও তেহরানে আছে এগুলো আমার স্ত্রীর। আমাকে ব্যবহারের জন্য হাদিয়া হিসেবে দুটো কার্পেট দেয়া হয়েছে, যদি আমি এগুলো ব্যবহার করা দরকার মনে করি। এগুলো আমার বা আমার বংশের কোনো সম্পত্তি নয় এবং এগুলো অবশ্যই অভাগ্রস্ত "সা'দাত” (রাসূল (সা.) এর বংশের) লোকদের দিয়ে দিতে হবে।
র আছে কিছু বই, যার অনেকগুলো শাহ আমলের নিরাপত্তা পুলিশ আমার বাসা অবরোধ করার সময় বাজেয়াপ্ত করেছিলো, কতকগুলো বই আমার তেহরানে থাকাকালে সেগুলোর লেখকগণ উপহার দিয়েছেন। এগুলোর মূল্য আমি জানি না, তবে তার পরিমাণ খুব বেশি হবে না।
আমার বাসার আসবাবগুলো (জামারানে) বাড়ির মালিকের।
(iii) উপরোল্লিখিত পরিমাণ ছাড়া যে সমস্ত অর্থ ব্যাংকে বা বাসায় রয়েছে তা আমি কতিপয় ব্যক্তিকে দিয়েছি। এগুলোতে আমার বা আমার সন্তানদের কোন অধিকার নেই। আমি তাদের অংশ আমার অসিয়তে নির্দিষ্ট করে দিয়েছি।

রুহুল্লাহ আল-মুসাভী আল-খোমেনী
জানুয়ারি ১৪, ১৯৮১




ব্লগটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করুন এখানে (সাইজ ১৫ মেগাবাইট)।
টেক্সট-ওনলি ভার্সন ডাউনলোড করুন এখানে, (সাইজ ২৫০ কিলোবাইট)।

লেখাটি ভালো লাগলে নিচের আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগ এবং আহমদ দীদাতের ইরান অভিজ্ঞতা

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

[ব্লগে কমেন্ট পোস্ট করার পরও যদি না দেখায়, তাহলে দ্বিতীয়বার পোস্ট করার প্রয়োজন নেই। খুব সম্ভবত স্প্যাম গার্ড সেটাকে সরিয়ে নিয়েছে, আমি পাবলিশ করে দেবো।]

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিয়া-সুন্নি বিরোধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং উভয় পক্ষের জবাব

শিয়া-সুন্নি বিভেদ ও দ্বন্দ বহু পুরনো বিষয়। এই দ্বন্দ নিরসনে ইতিহাসে বহু দ্বীনি ব্যক্তিত্ব বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবের পরপর ডা. জাকির নায়েকের ওস্তাদ আহমদ দীদাত ইরানের যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, যা আমি এক সপ্তাহ আগে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলাম । যা-ই হোক, এই দ্বন্দ নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের জন্য একটি নেতিবাচক ও দুর্বলতার দিক। এমনকি তা অনেককে চরমপন্থার দিকেও নিয়ে গিয়েছে। আগে যেই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ আলেমসমাজ ও কতিপয় জানাশোনা ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো, বর্তমান সহজ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তা প্রায় সকল লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, একদল আরেক দলকে এমন অনেক অভিযোগ করছে, যেগুলো হয়তো শিয়া-সুন্নি উভয় আলেমই অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করে দেবেন। তবে তথ্যের অবাধ প্রবাহের একটি সুবিধা হলো, এতে মিথ্যার প্রচার যেমন অতি সহজ, তেমনি একইভাবে মানুষের দ্বারে সত্যকে পৌঁছে দেওয়াও খুব সহজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিয়া ও সুন্নি উভয়কেই মুসলিম ভাই বলে গণ্য করি। কিন্তু তাদের বৃহত্তর ঐক্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা, পরস্পর শত্রুতা ও প্রেজ

শিয়া-সুন্নি ঐক্য ডায়লগ এবং আহমেদ দিদাতের ইরান অভিজ্ঞতা

(লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন। ) আহমেদ দিদাত ( ১৯১৮ - ২০০৫ ) এর নাম হয়তো অনেকের অজানা থাকবে। তবে ডা . জাকির নায়েকের নাম নিশ্চয়ই অজানা নয়। ডা . জাকির নায়েকের বর্তমান কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা হলেন আহমেদ দিদাত। আহমেদ দিদাত , যিনি কিনা ডা . জাকির নায়েকের নাম দিয়েছিলেন " দিদাত প্লাস " – পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লেকচার দেয়া ছিলো তাঁর কাজ। যাহোক , ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইসলামী ইরানের জন্ম হয়। বিপ্লব - পরবর্তী ইরানে ভিজিট করেন আহমেদ দিদাত , সাক্ষাৎ করেন ইমাম খোমেইনীর সাথে এবং নিজদেশে ফিরে এসে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন। আহমেদ দিদাতের নানা বিষয়ে বক্তব্য ও চিন্তাভাবনা বাংলা ভাষায় কিছু না কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু শিয়া - সুন্নি ঐক্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর চমৎকার বক্তব্যের অনুবাদ কোথাও না পেয়ে সবার সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই অনুবাদ করে ফেললাম। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। মূল অডিও কোথাও কোথাও শুনতে বা বুঝতে অসুবিধা